বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৪০ কোটিতে দাঁড়াবে। বিশেষ করে ভারত, চীন ও ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর প্রধান কারণ সেখানকার মানুষদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। স্থূলতা, চলাফেরার অভাব, মন্দ খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি রোগটিকে বিশেষ করে প্রভাবিত করছে । ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে নিবিড় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা একটা লাভজনক ব্যবসাও বটে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানা গবেষণা ও পদ্ধতি নিয়ে আজ আমরা কথা বলব।
১ম পদ্ধতিঃ ডায়েট, যোগব্যায়াম,মেডিটেশাণ
এতকাল ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ বলা হতো না। চিকিৎসা বিজ্ঞাণের গবেষকরা বর্তমানে বলছেন ডায়েট বা খাদ্যাভ্যাস কঠোরভাবে মেনে চললে, সঙ্গে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করলে ৭২ ঘণ্টায় ডায়াবেটিস কিওর বা ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি সম্ভব।
সম্প্রতি এক কর্মশালায় ৩৪ জন ডায়াবেটিক রোগীর উপর এ পদ্ধতি অনুসরণে সাফল্য পেয়েছেন এমন মন্তব্য করেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে ৬০ ভাগের বেশি রোগী ইনসুলিন ও ওষুধ ছাড়া বর্তমানে ভালো আছেন। বাকি ৪০ শতাংশ রোগী ওষুধের পরিমাণ ও ডোজ কমাতে পেরেছেন।“ডায়াবেটিস টাইপ ওয়ান অ্যান্ড টু কিওর ইন সেভেন্টি টু আওয়ার্স”- বইয়ের আলোকে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
মানসিক চাপ বা স্ট্রেস, সঠিক খাদ্য গ্রহণ না করা, ব্যায়ামের অভাব ও বংশগত কারণ ডায়াবেটিস হওয়ার প্রধান কারণ। কর্মশালায় ব্যক্তিবিশেষে সঠিক ক্যালরি বজায় রেখে খাদ্যাভ্যাস কেমন হবে এবং যোগব্যায়াম ও মেডিটেশনের মাধ্যমে কীভাবে বডি ও মাইন্ডকে নিজের কন্ট্রোলে রাখা যায় সেই টেকনিক শেখানো হয়েছে। সর্বোপরি ডায়াবেটিস পরাস্ত করা ডায়াবেটিক রোগীর সদিচ্ছা ও দৃঢ়তার ওপরও নির্ভর করে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন ।
২য় পদ্ধতিঃ ইনসুলিনে নির্ভরশীলতা
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগটি দুই ধরনের হয়ে থাকে: টাইপ-১ ও টাইপ- ২। সাধারণত অল্পবয়সীরা আক্রান্ত হয় টাইপ ১ ডায়াবেটিসে। যেমনটি দেখা যায় অনেক অল্প বয়স্ক কিশোর কিশোরীদের ক্ষেত্রে।উদাহরণ হিসেবে অলিভারের কথা বলাই যায় যার বয়স ছিল মাত্র ১৮। হঠাৎ করেই সে ক্লান্তি বোধ করতে শুরু করে। তার ওপর আবার ওজন কমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়, বেড়ে যায় মূত্রত্যাগের বেগও। ১০ বছর ধরে হানোফার শহরের এই ছাত্র দৈনিক ইনসুলিন ইনজেকশন নিচ্ছে।অলিভার জানায়, রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে আমি ইনসুলিন ইনজেকশন নেই। এটা ২৪ ঘণ্টা কাজ করে।
৩য় পদ্ধতিঃ অ্যান্টিবডির আশ্রয়
অল্পবয়সীদের যাতে সবসময় টাইপ ১ ডায়াবেটিস নিয়ে মাথা ঘামাতে না হয়, সেজন্য গবেষকরা ইনসুলিনের বিকল্প কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে একটি পদ্ধতি হলো দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাতে ইনসুলিন উৎপাদনকারী বেটাসেলগুলোকে আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্যে এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করা।
হানোফার শহরের মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির এল্মার ইয়েকেল এই প্রসঙ্গে জানান ‘এটা রোগ নির্ণয়ের সময় দেয়া এককালীন এক থেরাপি। এরপর রোগীকে আর চিকিৎসা দিতে হয় না। একবারই দিতে হয় বলে এক আকর্ষণীয় পদ্ধতি এটি। এর মূল লক্ষ্য: রোগ নির্ণয়ের সময় টিকে থাকা বেটাকোষগুলোকে রক্ষা করা ও কাজে লাগানো।’
আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল গবেষণায় এই পদ্ধতি নিয়ে মানুষের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। এতে হানোফার-এর মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিও অংশ নিয়েছে। তবে ফলাফলটা পাওয়া গেছে বিভিন্ন রকমের। ইউরোপ ও অ্যামেরিকার হালকা পাতলা দেহের তরুণ ডায়াবেটিস রোগীরা অ্যান্টিবডির উপাদান থেকে উপকার পেয়েছে। কিন্তু এশিয়ান অঞ্চলের রোগীরা আশাব্যঞ্জক তেমন কিছু দেখাতে পারেনি। এল্মার ইয়েকেল জানান, ‘আমরা মনে করি টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে এশিয়ার দেশগুলোতে অন্য কারণ থাকতে পারে।’
৪থ পদ্ধতিঃ রক্তের স্টেমসেল
আরো কিছু গবেষণার মাধ্যমে বোঝা যাবে, কেন টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের সবার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির উপাদান কাজে লাগছে না। অন্য দিকে, ব্রাজিলের গবেষকরা স্টেমসেল নিয়ে গবেষণা করছেন।
৫ম পদ্ধতিঃটিকা পদ্ধতি
তবে টাইপ ১ ডায়াবেটিস দমন করার ব্যাপারে আর একটি পদ্ধতি বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। আর তা হলো টিকা দিয়ে এই প্রকারের ডায়াবেটিস দমন করা। কয়েকটি ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। হয়তো বছর তিনেকের মধ্যে প্রথম টিকাটি বাজারে আসবে। অন্য দিকে, ডায়াবেটিস টাইপ ২-এর ক্ষেত্রে একটি ভালো খবর রয়েছে| আর তা হলো, একটি ওষুধ কিছুদিনের মধ্যেই অনুমোদন পেতে যাচ্ছে, যার নাম ‘ফরক্সিগা’। এর সাহায্যে কিডনিকে এমনভাবে উদ্দীপিত করা হবে, যাতে রক্তের অতিরিক্ত শর্করা মূত্রের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে রোগীদের আর ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
৬ষ্ঠ পদ্ধতিঃ খাবার
বিভিন্ন খাবার নিয়মিত ও পরিমাণ মত খেলে এই রোগ নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। বেশি বেশি সবুজ সবজী, টক দই, বাদাম এগুলো অন্যতম ।অনেক রকমের বাদাম বিশ্বে উৎপাদিত হয়। সব বাদামই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার ও তেলের জরুরি উৎস বাদাম। পরিমিত পরিমাণে বাদাম খেলে সুস্থ থাকা সম্ভব। বাদামে আছে ফসফরাস, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, কপার, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন। এটি রক্ত শুদ্ধ করে। লিভার ও কিডনি ভালো রাখে। কাজু বাদামে আছে আয়রন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ভিটামিন-এ। এটি রক্তশূণ্যতা কমিয়ে দেয়। ত্বক উজ্জ্বল করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
নিয়মিত পেস্তাবাদাম খেলে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে। ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি খুব একটা থাকে না। কম মাত্রার ক্যালরি, উচ্চমাত্রার প্রোটিন, নিম্ন মাত্রার সম্পৃক্ত ফ্যাট আর উচ্চ মাত্রার অসম্পৃক্ত ফ্যাট সবই কিন্তু ওজন কমানোর জন্য সহায়ক। পেস্তা বাদাম ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সক্রিয় থাকে। এই বাদামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গ্লাইকেশন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস বাড়তে দেয় না।