দেশজুড়ে হিংসা-বিদ্বেষে গভীর সংকটে মনুষ্যত্ব। চারিদিকে খুন-সন্ত্রাস ও উগ্র প্রাদেশীকতায় বিনষ্ট জাতীয় ঐক্য।তবুও কবির কথায় ‘আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে যাব। ‘আজও জীবন্ত ভূপেন হাজারিকার মানবিক আবেদনধর্মী গানের পঙতি ‘মানুষ মানুষের জন্য। ‘কোথাও বাঙালি খেদাও, কোথাও বিহারি খেদাও চলছে দেশের নানা প্রান্তে। বিপন্ন হচ্ছে জাতীয় অখন্ডতা এবং বহুত্যের মধ্যে ঐক্যের সংস্কৃতি। এরই মাঝখানে এক মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল ভাঙড়ের কয়েকজন যুবক।
ওদের বন্ধু ভাঙড় মহাবিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ইতিহাস বিভাগের মেধাবি ছাত্র। তার নাম রাকিবুল ইসলাম রাকিব। বাড়ী ভাঙড় ১ নং ব্লকের চন্দনেশ্বর গ্রামে। হঠাৎ ধরা পড়ল মারণ ব্যাধি ব্লাড ক্যানসার। প্রচুর অর্থের প্রয়োজন তার চিকিৎসার জন্য। অত টাকা পাবে কোথায়, দুঃচিন্তায় পরিবার। রাকিবের পরিবারের মানবিক আবেদন সাড়া দিলেন ভাঙড় মহাবিদ্যালয়ের প্রায় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এগিয়ে এলেন এলাকার সুহৃদয় ব্যাক্তি ও সমাজসেবিরা। তাও বাঁচানো যায়নি রাকিবকে। অকালে ঝরে গেল একটা স্বপ্ন। থেমে গেল যৌবনের তারুণ্য।
২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর নিউটাউনের টাটা মেডিকেল হাসপাতালে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে সবার প্রিয় রাকিব। শোকে মূহম্যান হয়ে পড়ে তার পরিবার- আত্মীয় থেকে শিক্ষক ও বন্ধুরা। মেনে নিতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল তাদের যে, রাকিব আর নেই। তাও বাস্তবতাকে তো আর অস্বীকার করা যায়না। রাকিব আর শারিরীক ভাবে ফিরে আসবে না। কিন্তু রাকিব থেকে গেলেন তার বন্ধুদের হৃদয়ে। তার আত্মার শান্তির জন্য কিছু করতে হবে। এই চিন্তা ভাবনা থেকেই শাকিল আহমেদ উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন তার অন্য বন্ধুদের। ঠিক করলেন, রাকিব যে মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছিল সেই ক্যানসার আক্রান্তদের জন্য কিছু করতে হবে।
শনিবার প্রভাতে ২৫ জন বন্ধু রওনা হয় নিউটাউনের টাটা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্তদের রক্তার্পণ করার জন্য।কিন্তু নানা কারণে গৃহীত হয় ১৫ জনের রক্ত।সব মিলিয়ে তারা ৫ ইউনিট রক্তার্পণ করে। ইতিমধ্যে জানা যায়, এক বিহারি যুবক ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে রক্ত চাই। ভাঙড়ের ছেলেরা উদ্যত হল বিহারি যুবককে রক্ত দেওয়ার জন্য। পুরো রক্তই তুলে দেওয়া হল তার পরিবারের হাতে।
হিন্দী ভাষাতেই আক্রান্ত যুবকের পরিবারের এক সদস্য এই ঘটনায় অভিভূত। তিনি বলেন, ভিনরাজ্যে এসে এইভাবে সাহায্য পেয়ে খুব ভালো লাগছে। ওদের দেওয়া রক্তে ভাইয়ের প্রাণ বাঁচবে তাই তিনি কৃতঞ্জ। আক্রান্তের ছোট্ট শিশু মেয়ে বলেন, বাবার জন্য যারা রক্ত দিয়েছে ভগবান তাদের ভাল রাখবেন।
রক্তদাতাদের মধ্যে সাকিল আহমেদ বলেন, আমাদের প্রিয় বন্ধু রাকিব গত বছর এই দিনে ৮ ডিসেম্বর মারণ ব্লাড ক্যানসারে মারা যায়। সেজন্য আমরা ঠিক করি ,যে রোগে সে মারা গেছে তাদের জন্য আমাদের কিছু করতে হবে। তাই আমরা এক সঙ্গে ১৫ জন বন্ধু ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্তদের জন্য রক্তার্পণ করলাম। সাকিল আরও বলেন রাকিবের স্বপ্ন ছিল সমাজের জন্য,মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। তাই তার অপূর্ণ স্বপ্নকে পাথেয় করে আমরা এই উদ্যোগ নেই। রক্তদানের পাশাপাশি দুঃস্থ মানুষ ও শিশুদের জন্য কিছু খাবার সামগ্রী বিতরণ করা হয়। কারণ তাদের বন্ধু শিশুদের ভীষণ ভালবাসত। বন্ধুদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পণা হল রাকিবের নামে একটি সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট তৈরি করবে তারা। যেখান থেকে দুঃস্থ মানুষ ও শিশুদের জন্য কিছু করা হবে।