ভাইফোঁটার ইতিকথা

বিশেষ প্রতিবেদনঃ সভ্যতার ইতিহাসের সাথে সংস্কৃতির এক অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে। সেই ধারায় অনেক আচার-অনুষ্ঠান শতাব্দীর পর শতাব্দী পালিত হয়ে আসছে নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে। এমনই একটি সংস্কার ‘ভাই ফোঁটা’। পোশাকি নাম ‘ভাতৃদ্বিতীয়া’। প্রতি বাংলা বছরের কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় এ অনুষ্ঠান। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় তার কপালে টিকা দেন বোন। তাই ‘ভাইটিকা’ বললেও ভুল হবে না।

ভাই ফোঁটা নিয়ে রয়েছে অনেক গল্প-কাহিনী। দিদা-ঠাকুরমাদের কাছ থেকে শোনাঃ মৃত্যুদূত যম ও যমুনা যমজ ভাইবোন। সূর্যের ঔরসে জন্ম তাদের। বড় হওয়ার পর দুজনে আলাদা হয়ে যান। থাকতেন পরস্পর থেকে অনেক দূরে। লম্বা সময়ের ব্যবধানে যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাইকে দেখতে। বার্তা পাঠালেন তাকে। বোনের নিমন্ত্রণে যমরাজকে আসতেই হলো। যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলেন যমুনা। ফেরার সময় আবারো আসার প্রতিশ্রুতি দিলেন যম। তখন খুশিতে ভাইকে আশীর্বাদ করে টিকা পরিয়ে দিলেন কপালে। সেই থেকেই নাকি ভাই ফোঁটার প্রচলন। আবার কথিত আছে, নরকাসুর নামের এক দৈত্য বধের পর কৃষ্ণ ফিরে এসেছেন বোন সুভদ্রার কাছে। তখন তাকে কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন সুভদ্রা। অনেকের মনে করেন, ভাই ফোঁটার শুরু এর মধ্য দিয়েই।

যম-যমুনা বা কৃষ্ণ-সুভদ্রা, যাদের দ্বারাই এ অনুষ্ঠানের প্রচলন হোক না কেন, আজো তা বজায় রয়েছে। ভাইবোনের মধ্যে পবিত্র সম্পর্কের বার্তাকে আরো সুদৃঢ় করে এ রীতি। ছেলেবেলার খুনসুটির সঙ্গী। বড় হয়ে জোট বেঁধে কোনো দুষ্টুমির আকর তৈরি, ধরা পড়ে পৃষ্ঠদেশে উত্তম-মধ্যমের পাহাড়। আবার কখনো কোনো দুষ্ট বুদ্ধি সফল হলে হেসে গড়িয়ে পড়া একে অন্যের ওপর। দুপুরে ভাত ঘুমের আগে কাড়াকাড়ি করে গল্পের বই পড়ার স্মৃতিও তার সঙ্গে। আবার মতের অমিলে ঝগড়া করে কথা বন্ধ। ভাইবোনের সম্পর্কটাই এমন মজার।

শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়াতে ভাইকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানায় বোন। সন্ধ্যা বাতি দেখানোর পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। ভাইকে বসতে দেয়া হয় নকশিকাঁথার কাজ করা সূতির আসনে। কাঁসা বা পিতলের থালায় ধান-দূর্বা, ঘরে আমপাতায় পারা কাজল, চন্দন সাজিয়ে নিয়ে আসে বোন। সঙ্গে থাকে ঘিয়ের প্রদীপ আর শাঁখ। মিষ্টির রেকাবিও বাদ যায় না। বোন বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কাজল নিয়ে এঁকে দেয় ভাইয়ের ভ্রু-যুগল। এর পর মধ্যমা দিয়ে চন্দনের ফোঁটায় অঙ্কিত করে কপাল। সঙ্গে ছড়া কাটেঃ
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা

তবে ছড়াটি বিভিন্ন পরিবারে রীতিভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। চন্দন পরানো হয়ে গেলে ধান-দূর্বা দিয়ে ভাইকে আশীর্বাদ করে বোন। বাজানো হয় শাঁখ। তার পর বাড়িয়ে দেয় মিষ্টির রেকাবি। উপহার দেয়া-নেয়ার পালাও রয়েছে। আজ সেই পবিত্র তিথি। বোনরা দীর্ঘায়ু ও মঙ্গল কামনা করে ফোঁটা দেবে ভাইকে। এ কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, উৎসব। সবাই শামিল হতে পারেন এ উৎসবে।

Susmita Sarkar

Share
Published by
Susmita Sarkar

Recent Posts

ইতিহাস গড়েছে মোহনবাগান

মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট ১২ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অনুষ্ঠিত আইএসএল ২০২৪-২৫ ফাইনালে বেঙ্গালুরু এফসিকে…

44 minutes ago

অভিষেক শর্মার দুর্দান্ত শতরানে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ঐতিহাসিক জয়

১২ এপ্রিল ২০২৫, আইপিএল ২০২৫-এর এক উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ (SRH) ২৪৬ রানের বিশাল লক্ষ্য…

54 minutes ago

তামান্না ভাটিয়া ‘ওডেলা ২’ ছবিতে মন্ত্র-তন্ত্রের রহস্যে মোড়ানো চরিত্রে

দক্ষিণী ও বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তামান্না ভাটিয়া এবার পর্দায় হাজির হচ্ছেন এক রহস্যময় চরিত্রে। তাঁর…

1 hour ago

কলকাতার রাস্তায় হেনস্থার শিকার গায়িকা ইমন চক্রবর্তী: অভিযুক্ত গ্রেফতার

কলকাতার দক্ষিণ অঞ্চলে বৃহস্পতিবার রাতে হেনস্থার শিকার হন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তী। ব্যাডমিন্টন খেলে…

2 hours ago

ঢাকায় ফিলিস্তিনের পক্ষে প্রতিবাদ, গাজায় হামলা জোরদার করছে ইসরায়েল

ঢাকা, ১৩ এপ্রিল ২০২৫:গাজায় চলমান মানবিক বিপর্যয় ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঢাকায় হাজারো মানুষ রাস্তায়…

3 hours ago

ওয়াকফ আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে উত্তাল মুর্শিদাবাদ: হাইকোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন

পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভ সহিংস রূপ নিয়েছে। গত কয়েক দিনে…

4 hours ago