দেওয়ালে মুর্তি এঁকেই প্রথম কালী পুজো শুরু হাড়দা গ্রামের সিনহা পরিবারে

পশ্চিম মেদিনীপুর: আজ থেকে প্রায় ৭২ বছর আগের কথা। অধুনা ঝাড়গ্রাম জেলার হাড়দা গ্রামে বাস করতেন ওই জেলারই বিনপুর হাইস্কুলের কেরানি ব্রজগোপাল সিনহা ।অভাবের সংসারে সামান্য কেরানিগিরি করেই কোনো রকমে দিন গুজরাণ করেন ব্রজগোপাল বাবু।ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, পরিবারের সকলের দেখাশোনা, ভাতকাপড়ের দায়িত্ব একার কাঁধে হাসি মুখে বয়ে বেড়ান। তাই কেরানিগিরি পাশাপাশি টিউশান পড়ানো ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও করতেন। রোজ সংসার প্রতিপালনের জজন্য কষ্ট করতেন, চিন্তা করতেন কিন্তু কোনোদিন অসৎ পথ অবলম্বন করেন নি। কারন তিনি যে মা কালীর পরম ভক্ত। ব্রজগোপাল বাবুর সংস্কৃতে ছিল অগাধ পান্ডিত্য। তার উপর সৎ মানুষ হওয়ার কারনে সুনামও ছিল যথেষ্ট।

অনুমানিক বাংলা ১৩৫৪ সালে কার্তিক মাসের কালী পুজোর অমাবশ্যার আগের রাত্রে তিনি শুয়ে ভাবছেন, এই ভাবে আর কতদিন চলবে? তার অবর্তমানে সংসারের হাল কে ধরবে? এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। আধঘুম অবস্থায় তিনি অনুভব করলেন তাঁর শরীরে কি যেন কেউ ফেলছে। তিনি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। তাইতো এতো রাত্রে তাঁর শরীরে কে কি ফেলছে? এদিকে যেন ঘুমেরও ঘোর কাটতেই চাইছে না। এরই মধ্যে হঠাৎ মায়ের স্বপ্নাদেশ “এই অমাবস্যাতেই তুই আমার আরাধনা কর, তোর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে”। তারপরেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখেন বিছানার চারপাশে পড়ে রয়েছে আতপচাল আর বেল পাতা। ব্রজ বাবু পড়লেন মহা ফাঁপরে। অভাবের সংসার, তাই আবার মায়ের পুজা ? কি করে সম্ভব ? ঠিক তখনই দেখলেন, তিনি যে ঘরে তিনি শুয়ে ছিলেন সেই ঘরের এক কোনে রং তুলি রাখা আছে। তারপরই দৈববানি, “ওই রং তুলি দিয়ে দেওয়ালে আমার ছবি এঁকে পুজো কর”। তিনি ঘোরের মধ্যে ছবি আঁকতে শুরু করলেন । এদিকে তাঁর স্ত্রী মাধূরী দেবী পাশে ঘুমিয়ে থেকেও এতো যে কান্ড ঘটলো তা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি।কিন্তু ব্রজ বাবু যখন দেওয়ালে ছবি আঁকা শুরু করলেন তখন মাধুরীদেবীর ঘুম ভাঙ্গলে তিনি দেখেন দেওয়ালের সামনে তাঁর স্বামী কি যেনকরছেন। তিনি ডাকলেন কিন্তু কোনো উত্তর না পেতে ফের শুয়ে পড়েন । পরের দিন সকালে ব্রজ বাবু মাধুরী দেবীকে বললেন যে আজ বাড়িতে মা কালীর পুজো হবে। তাকে গত রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। অভাবের সংসারে শুরু হল মায়ের আরাধনা।

পুজো সম্পন্ন হল ধুমধাম করেই। এর কিছু দিন পর ঘটল আরেকটি আলৌকিক ঘটনা। মায়ের আদেশ তাঁকে পৈতা ধারন করতে হবে। কিন্তু ব্রজবাবু ছিলেন জাতিতে কায়স্থ। কায়স্থর ছেলেকে কে পৈতা দেবে বা কি ভাবেই তা সম্ভব? ব্রজবাবু তার কুল গুরু ও কুল পুরোহিত দুজন ঘটনাটা বললেন। তাদের কড়া জবাব, কায়স্থর ছেলেকে তাদের পক্ষে কোনোভাবেই পৈতা দিতে পারবেন না। এই সমস্যায় যখন জর্জরিত হয়ে পড়লেন ব্রজ বাবু তখন তিনি মনে মনে ঠিক করে নিলেন যে, যার আদেশ সেই বুজবে কি ভাবে তার কথার দাম জন সমক্ষে বাস্তবে রুপ পায়। এই সব ভাবতে ভাবতেই তিনি স্কুলের দিকে পা বাড়ান। পরদিন তার ঘুম ভাঙ্গার আগেই তার বাড়িতে এসে উপস্থিত তার কুল গুরু ও কুল পুরোহিত। কারন ব্রজর পৈতা হবে এবং আজই হবে। গুরুদেব ও কুল পুরহিতের সহায়তায় ব্রজ বাবুর পৈতা হলো ।

এই ভাবেই পূজো চলতে থাকলো বেশ ককয়েক বছর। কিন্তু মায়ের লীলা খেলা কে বুঝিতে পারে। তাইতো তার কর্ম তিনি করিয়ে নিচ্ছেন। টাটা কোম্পানির ইলেকট্রক বিভাগে কাজ করতেন ব্রজবাবুর শালা তারাপদ সরকার । তিনিও ছিলেন মায়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। একদিন তিনি ইলেক্ট্রিক খুঁটিতে উঠে কাজ করার সময় হাত ফস্কে হয়ে পড়ে যান মাটিতে। সেই সময় তারাপদ বাবুর মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে আসে “মা তারা রক্ষা করো “। মায়ের কি অপুর্ব খেলা। এতো উপর থেকে পড়েও শরীতে এতো টুকুও আঘাত লাগেনি। তখনই তারাপদ বাবু মনোস্থীর করেন যে তিনি মায়ের মন্দির গড়ে দেবেন । অন্যদিকে ব্রজবাবুর গ্রামেও ছিলেন আরেক ভক্ত দুর্গাচরন সাহা। তিনি বেশ ব্যাবস্যাদার লোক। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও সময় নেই আরাধনা করার। সেই সময় তার ব্যবসায় ভরাডুবি শুরু হতেই তিনি মায়ের স্মরনাপন্ন হলেন। ধীরে ধীরে আবার তার ব্যাবসা আগের মতোই ফিরে এলো। তিনি কুমোরটুলি থেকে মায়ের মুর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো তারাপদ ও দুর্গাচরন কে দিয়ে তিনি ব্রজ বাবুর বাড়িতে তার চিন্ময়ী প্রতিমা এবং মন্দির গড়িয়ে নিলেন। ১৩৬৪ সালে প্রথম শুরু হল মাটির মুর্তি তে মস্যের নিজস্ব মন্দিরে পুজো। সেই থেকে আজও সেই মন্দিরেই সেই মমুর্তিতেই চলছে পূজো। তিনদিন ধরে পুজো চলে। পুজোরপরের দিন আয়োজন করা হয় অন্নভোগের। সারা গ্রাম সহ পাশাপাশি প্রচুর মানুষ মহা তৃপ্তি সহকারে এই অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করেন। আর এই অন্ন ভোগের খরচ মায়ের কোন না কোন ভক্ত দেয়।

হাড়দার সিনহা বাড়ির মা কালী এখন শুধু সিনহা পরিবার বা হাড়দার মধ্যে বিস্তৃত তা নয়। বহু দুরদূরান্ত থেকে মায়ের ভক্তরা আসে তাদের মনস্কামনা নিয়ে। যারাই মায়ের কাছে আসেন শোনা যায় কেউ নাকি খালি হাতে ফিরে যায় না। মা তাদের মনোস্কামনা পুরন করে দেন। ব্রজবাবু মারা যাওয়ার পর তার ছেলে সমীর সিনহা মায়ের বর্তমান সেবায়ত। ব্রজগোপাল বাবুর আরেক ছেলে মতিলাল সিনহা বলেন “যতদিন সিনহা পরিবার থাকবে মায়ের পুজাও চলবে”।

Susmita Sarkar

Share
Published by
Susmita Sarkar

Recent Posts

শহরের নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার ওপর অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা

সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, সৌদি আরব সহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশ পাকিস্তানের অন্তত ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন…

2 weeks ago

৭১ হাজারেরও বেশি প্রাপকের হাতে চাকরীর নিয়োগ প

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে ৭১ হাজারেরও বেশি প্রাপকের হাতে চাকরীর নিয়োগ পত্র…

2 weeks ago

ডিসেম্বরে ভারতীয় পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ২৬ হাজার কোটি টাকার লগ্নি

ডিসেম্বর মাসে ভারতীয় পুঁজিবাজার বিদেশী বিনিয়োগকারীদের (এফপিআই) কাছ থেকে ব্যাপক লগ্নি লাভ করেছে। পুঁজিবাজারে জমা…

2 weeks ago

আইএসএল: কেরালা ব্লাস্টার্সের দাপুটে জয়, মহামেডান স্পোর্টিং বিপাকে

কোচির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে গতকাল আইএসএল ফুটবলে কেরালা ব্লাস্টার্স এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ৩-০ গোলে মহামেডান…

2 weeks ago

৩৭তম বিষ্ণুপুর মেলা: মল্লভূমের ঐতিহ্যের উন্মোচন

বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর আজ থেকে হয়ে উঠেছে ঐতিহ্যের এক নতুন উজ্জ্বল মঞ্চ। সূচনা হয়েছে ৩৭তম বিষ্ণুপুর…

2 weeks ago

প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী ও গুরু পৌষালী মুখোপাধ্যায় প্রয়াত

প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী ও গুরু পৌষালী মুখোপাধ্যায় প্রয়াত। শনিবার কলকাতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস…

2 weeks ago