দশ কেজির কাতান ও এক ফুটের শঙ্খ ধামচার কালী পূজোর মূল আকর্ষন

পশ্চিম মেদিনীপুর: সে আজ থেকে প্রায় পাঁচ শত বছর আগের কথা। কলকাতা কোনো এক কর্মকার দুরারোগ্যে ভুগতে ভুগতে এসে পৌঁছান গোয়ালতোড়ের ধামচাতে। বহু জায়গায় বহু ডাক্তার , কবিরাজ দেখিয়েছেন। কোথাও কেউ তার রোগ সারিয়ে দিতে পারেন নি। অবশেষে ধামচার কালী মন্দিরে এক কালী পূজোর রাত্রে এসে পৌঁছান । হয়তো এটা মায়ের এক লিলা । না হলে কলকাতা ছেড়ে কেন জঙ্গলের মাঝে অখ্যাত এক গ্রামে আসবেন। তিনি মায়ের সেবায়ত কে তার মনের দুঃখের কথা বলেন। সেবায়ত তখন তাকে নির্দেশ দেন, যে পুকুরে মায়ের ঘট ডুবানো ও বিসর্জন দেওয়া হয় সেই পুকুরে স্নান করে আসার । স্নান করে আসার পর মায়ের পূজোর ঘটের জল ছিটিয়ে দেন তাঁর গায়ে । আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি সেই দূরারোগ্য থেকে মুক্তি পান । রোগমুক্ত হওয়ার পর নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে দশ কেজি ওজনের একটি কাতান মায়ের উদ্দ্যেশ্যে তিনি সমর্পন করে যান। সেই থেকে সেই কাতান দিয়ে আজও মায়ের পূজোর সময় বলি দেওয়া হয় । কিন্তু আজ এত বছর পরও সেই কাতান একই রকম আছে। ওজ্জ্বল্য বরং বেড়েছে দিন দিন। নেই কোনো ক্ষয়বয়।

গোয়ালতোড়ের ঘোষ বাড়ির কালী পূজো যে কত দিন ধরে চলছে বর্তমান প্রজন্মের সদস্যরা ঠিক ভাবে না বলতে পারলেও আনুমানিক পাঁচশো বছর তো হবেই । এই মন্দিরের বর্তমান সেবায়ত শঙ্কর প্রসাদ ঘোষ বলেন , ” তখন এই এলাকা গুলি সম্পূর্ন জঙ্গলে ঘেরা ছিল । এই ঘোষ পরিবারের পূর্ব পুরুষরা জঙ্গলে কাঠ আনতে যেত । গাড়ি নিয়ে কাঠ আনতে গিয়ে হঠাৎ করে মাঝ জঙ্গলে একদিন গাড়ির ওদল ভেঙ্গে যায়। মাঝ জঙ্গলে এই সমস্যায় পড়ার দরুন বেশ বিপদ গনলেন তারা। তাইতো এখন কি হবে। এমন সময় একটি লাল পাড় সাদা শাড়ি পায়ে আলতা , ফুটফুটে একটি মেয়ে হাজির তাদের সামনে। এসেই মেয়েটি তাদের সঙ্গে যাওয়ার বায়না ধরলেন। কিন্তু যাবো বললেই তো আর যাওয়া যায় না।

প্রথমত কার মেয়ে, কোথায় বাড়ি তার কিছুই জানেন না তারা, তারউপর দুখের সংসারে তারা নিজেরা জঙ্গল থেকে কাঠ এনে সংসার চালান। মাঝ জঙ্গলে এই রকম বিপদ । কিভাবে নিয়ে যাবে তাকে । অনেক অনুনয় বিনয় করার পর অবশেষে যখন রাজি হলেন ঘোষ পরিবারের লোকেরা ঠিক তখন মা তার নিজ মুর্তি ধরে বলেন আমি তো এই ভাবে যাবো না । শিলাবতী নদীর তীবে বাঁশকোপার সামনে একটি ঘাটে কালী পূজোর দিন আমি জলে দেখা দেবো । সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে । তখন অবশ্য ঘোষ পরিবারের লোকেরা ধামচা তে আসেন নি। তাদের বাড়ি ছিল গড়বেতার সামনে গাংড়াতে । তারা সেই কালী পূজোর দিন শীলাবতী নদীতে দেখেন কেউ একজন ডুবছে উঠছে। তাকে উদ্ধার করতে নেমে মা কালী কে উদ্ধার করে নিয়ে আনেন । সঙ্গে ওই জলেই পান একটি প্রমান সাইজের ঢাক ও একটি এক ফুটের শঙ্খ । মা কালী কে নিয়ে এনে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় গাংড়াতে । সেখানেই শুরু হয় পূজোর্চনা।

পরে গ্রহের ফেরে ঘোষ পরিবারের লোকেরা চলে আসেন ধামচা তে । সেখানে প্রতিষ্ঠা করা নতুন মন্দির ও মায়ের পূর্নাঙ্গ অবয়ব । শুরু হয় পূজো । দেখতে দেখতে সেই পূজোও প্রায় পাঁচ শত বছর হল । ধামচার ঘোষ পরিবারের মা কালীর এই পূজোতে বাইরে থেকে কোনো প্রকার ঢাক বা শঙ্খ আনা হয় না । উদ্ধার হওয়া ওই ঢাক ও শঙ্খ দিয়েই মায়ের পূজো করা হয় “। ধামচার ঘোষ বাড়ির কালীর এক বিশেষ মাহাত্ব্য হল এখানে বহু মানুষ বিভিন্ন রকম দুরারোগ্য রোগ নিয়ে আসেন , আবার নিসন্তান মহিলারা পুত্র কামনায় আসেন মায়ের কাছে মানত করতে , মা তাদের মনস্কামনা পূর্ন করে দেন । ঘোষ পরিবারের বর্তমান সদস্য বাপন ঘোষ বলেন , “যারা সন্তান কামনায় মায়ের কাছে মানত করে আসেন তাদের মায়ের ঘট বিসর্জন দেওয়ার আগে যে পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয় সেই পুকুরে নতুন কাপড় পরিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় । তারপর ঘট বিসর্জনের পর তাদের পুকুর থেকে তুলে দিয়ে ঘটের জল মাথায় ছিটিয়ে দেন বর্তমান সেবায়ত । তারা এতে ফল পায় । প্রতি বছরেই মানতকারীর সংখ্যা বাড়ে “।

পূজো মূলত তিন দিন ধরে চলে । তবে প্রতি বছরেই যে প্রতিমা তিন দিন থাকে এমন কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম নেই । কারন ঘোষেদের এই প্রতিমার বিসর্জনের পিছনেও রয়েছে আরেক কাহিনী । কোনো এক বছর তিন দিনের দিন ভাই ফোঁটা পড়ে । সেই দিন বিসর্জন দিতে গিয়ে ঘোষ পরিবারের লোকেরা ভয়ানক প্রকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন । এতো ঝড় বৃষ্টি হয় যে সেই রাত্রী তে তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারেন নি । পর দিন সকালে বাড়ি ফিরে আসেন । তারপর থেকে ভট্টাচার্য্য এসে দিনক্ষন ঠিক করে দেন কবে মায়ের বিসর্জন হবে। ঘোষ পরিবারের কালী পূজো ঘোষ বাড়ির নামেই ,বর্তমানে এই পূজোতে ধামচা সহ পাশাপাশি গ্রামের লোকেরাও মেতে উঠে । বাড়িতে বাড়িতে আত্মীয় স্বজন আসে । ঘোষ পরিবারের সদস্যরাও যে যেখানেই থাকুক এই পূজোতে সকলেই এসে উপস্থিত হন । এক কথায় ঘোষ পরিবারের কালী পূজো আদতে ধামচার মিলন মেলা ।

Susmita Sarkar

Share
Published by
Susmita Sarkar

Recent Posts

চীনা মাস্টার্স ব্যাডমিন্টন: সেমিফাইনালে ভারতের চিরাগ শেট্টি ও সাত্তিক সাইরাজ রণকি রেড্ডি

চীনের সেনজেনে আজ চীনা মাস্টার্স ব্যাডমিন্টনের সেমিফাইনালে ভারতের চিরাগ শেট্টি ও সাত্তিক সাইরাজ রণকি রেড্ডি…

2 days ago

গোয়ায় চলছে ৫৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব: তৃতীয় দিনের আকর্ষণ

গোয়ায় জমকালো পরিবেশে চলছে ৫৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (ইফি)। চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্য এই উৎসব এক অনন্য…

2 days ago

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক এজেন্ডা: ধনকুবের স্কট বেসেন্ট ট্রেজারি সেক্রেটারি হিসেবে মনোনীত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে ধনকুবের স্কট বেসেন্টকে ট্রেজারি সেক্রেটারি…

2 days ago

তথ্য সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে নতুন আইনি রূপরেখা আনতে চলেছে ভারত সরকার: পীযূষ গোয়েল

তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে বড় পদক্ষেপ নিতে চলেছে ভারত সরকার। বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়েছেন,…

3 days ago

জ্ঞানভাপী মসজিদ: ওজুখানায় শিবলিঙ্গের দাবিতে মসজিদ কমিটির বক্তব্য তলব

জ্ঞানভাপী মসজিদের ওজুখানায় শিবলিঙ্গ থাকার দাবিতে হিন্দু পুণ্যার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মসজিদ কমিটির অবস্থান জানতে…

3 days ago

বঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ফেঙ্গালের প্রভাব: আংশিক মেঘলা আকাশ ও বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস

কলকাতা, ২২ নভেম্বর ২০২৪:বঙ্গোপসাগরে তৈরি হতে চলা ঘূর্ণিঝড় ফেঙ্গাল পশ্চিমবঙ্গের আবহাওয়ায় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।…

3 days ago