ঝাড়গ্রাম: এবার পুজোয় ঝাড়গ্রাম জেলাজুড়ে থিমের ছড়াছড়ি। শহরের পাশাপাশি গ্রামের পুজোগুলিও থিমের পুজোয় একে অপরকে টেক্কা দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। কোথাও ‘মৌবনে মৌমাছি, আবার কোথাও ‘পুরানোকে নতুন ভাবে দেখা’ থেকে শুরু করে ‘দশভুজার চিরসাজে প্রতিরোধের বাদ্যি বাজে’, ‘একতাই সম্প্রীতি’,‘ডুবন্ত দুর্গা’, ‘পর্বত ধাম’, ‘’ইতি গজ’, ‘মিশর’ আবার কোথাও প্রাণের খোঁজে অরণ্য’ ফুটে তুলছেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা।
সংঘমিত্র ব্যায়াম সমিতি ২৭ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘মৌবনে মৌমাছি’। বাঁশ, কাপড়, ফোম, চট, থার্মোকল, দিয়ে ফুলের আদলে মণ্ডপ তৈরি করা হচ্ছে। সেই ফুলের উপর প্রকান্ড এক মৌমাছি। মণ্ডপের ভিতরে একটি গাছের ডালে ডালে অজস্র মৌচাক। এছাড়াও নির্বিচারে গাছ কাটায় ও মোবাইল টাওয়ায়ের ভারসাম্য কিভাবে নষ্ট হচ্ছে। শহরের অফিসার্স ক্লাবে ৬৯ বছরে পুজোর থিম ‘পুরানোকে নতুন ভাবে দেখা’। কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ির আদলে মণ্ডপটি তৈরি করা হচ্ছে। কুমোরটুলির প্রতিমা ও রকমারি আলোকসজ্জা। ঝাড়গ্রাম পূর্বাশা ৩৬ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘দশভুজার চিরসাজে প্রতিরোধের বাদ্যি বাজে’। লাঞ্চনা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নারীর এক রূপ। ১৫ ফুট উচ্চতার দেবীর মুখ দিয়ে প্যান্ডেলে ঢোকার বাঁশ, ফোম ও প্লাইবোর্ড, ইটের টুকরো দিয়ে প্যান্ডেলটি তৈরি করা হয়েছে। নারীদের উপর অত্যাচার রয়েছে, নারীরাও প্রতিরোধ করতে পারে, তবে পুজোয় বিশেষ আকর্ষণ থাকছে রংহীন সুতোর তৈরি প্রতিমা।
প্যান্ডেলের চারিদিকে গাছ লাগানো হবে। শহরে শাল গাছ যাতে না কাটা হয়, সেই বার্তা দেবেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। পুজো কমিটির উদ্যোক্তা ঘনশ্যাম সিংহ বলেন, ঝাড়গ্রাম পূর্বাশার পুজোতে প্রতি বছরই নতুনত্ব কিছুই চমক থাকে। এবারও সেই চমক রয়েছে। ঘোড়াধরা সর্বজনীন ৫৩ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘একতাই সম্প্রীতি’। হোগলা পাতা, মাদুর, মাটি দিয়ে মন্ডপ সাজানো হচ্ছে। সমস্ত ধর্মের প্রতীক প্যান্ডেলে ফুটে উঠবে। পুজো মন্ডপ থেকে শান্তির বার্তা দেবে পুজো উদ্যোক্তারা। মাঝেরপাড়া সর্বজনীন ১৩ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘প্রাণের খোঁজে অরন্যে’। পুজোর বাজেট ৮ লক্ষ টাকা। এখানে পুজো মণ্ডপে জঙ্গলের পরিবেশ ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। জঙ্গলের মাঠে বিভিন্ন জীব জন্তু থাকবে। অরণ্য ধ্বংস, বন্যপ্রাণ হত্যা থেকে বিরত থাকা ও সবুজকে রক্ষা করার বার্তা দেবেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা।
আবার অশান্তি-অসুরকে দূরে ঠেকাতে ২০১৬ সাল থেকে মাটি খুঁড়ে সর্বজনীন দুর্গা পুজোর আয়োজন করছেন ঝাড়গ্রামের বিরিহাঁড়ি উদীয়মান তরুণ সঙ্ঘ। তৃতীয় বর্ষে উদ্যোক্তাদের চমক ‘ডুবন্ত দুর্গা’। বিরিহাঁড়ি গ্রামের তরুণ সঙ্ঘের মাঠে ছ’ফুট গভীরতা বিশিষ্ট একশো বর্গফুটের পুকুর কাটা হয়েছে। একেবারে প্রাচীন দিঘির মতো করে গড়ে তোলা হবে ওই জলাশয়। পুকুরের নীচে তৈরি হয়েছে ১২ ফুট গভীর ও ৬০ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গপথ। সেই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে দর্শকরা পৌঁছবেন জলাশয়ের বাইরে কলসি আকৃতির মূল মণ্ডপে। বিরিহাঁড়ি উদীয়মান তরুণ সঙ্ঘের সম্পাদক জগদীশ মাহাতো বলেন, গত দু’বছরে দুরদূরান্ত থেকে কয়েক হাজার দর্শক এসেছিলেন। এবারও নতুনত্ব রয়েছে। লোধাশুলি সর্বজনীন ৫১ তম বর্ষ। পুজোর বাজেট ৭ টাকা। পুজোর থিম ‘মানব কন্যা তুমি যে অনন্যা’। এই মণ্ডপে সমাজে নারীর উপর অত্যচার, বাল্য বিবাহ, ভ্রুণ হত্যা থেকে শুরু করে নারীদের বিভিন্ন সাফল্যের দিক তুলে ধরতে চাইছেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মত সাফল্যের দিক গুলিপ দেখা যাবে। মটির আদলে প্রতিমা থাকছে। জামবনী ব্লকের ডুমুরিয়া সর্বজনীন ৬১ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘ইতি গজ’। সম্প্রতি ডুমুরিয়া এলাকায় ট্রেন লাইনে দু’টি পূর্ন বয়স্ক হাতি ও একটি শাবক হাতি জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে কাটা পড়ে ছিল।
ঘটনাস্থলেই তিনটি হাতির মৃত্যু হয়েছিল। ডুমুরিয়া সর্বজনীন এবার সেই মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে চাইছেন। তিনটি হাতির কাটা পড়ার চিত্র দেখতে পাবেন সাধারণ মানুষজন। দু’হাজার দু’শ বর্গফুট এলাকা জুড়ে চট, থার্মোকল, রং, বাঁশ দিয়ে দু’টি ট্রেন লাইন ও কাটা পড়া হাতির দেহ ফুটিয়ে তুলেছেন। গিধনি পূর্বাশা ১৮ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘পূর্বাশা এবার বাম হাতে’। পুজোর কমিটির সদস্য তথা শিল্পী তপন মাহালির ভাবনায় গড়ে উঠছে এই পুজো মণ্ডপ। সাপে কামড়ালে মানুষ ওখন মানুষ ওঝার কাছে গিয়ে যেভাবে মারা যাচ্ছেন, তা ফুটিয়ে তোলা হবে। পাশাপাশি সাপে কামড়ালে কি করা উচিত তার বার্তা দেওয়া হবে। গিধনি স্পোর্টিং ক্লাবের ৭৪ তম বর্ষ পুজোর থিম ‘তোমরা দুর্গা ও আমার দুর্গা’। ভ্রূণ হত্যার পাশাপাশি মেয়েরা এই সমাজে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত, মেয়েরা কিভাবে লাঞ্চিত, ধর্ষিত হচ্ছে তা দেখা যাবে। হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি থাকছে প্রতিমা। প্রতিমা। পুজো কমিটির সভাপতি নবকুমার ভুঁইয়া বলেন, পযর্টক থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ড রাজ্য থেকে প্রচুর মানুষজন আসেন এখানে পুজো দেখতে। দশমীর পরও তিন-চারদিন ধরে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হয়।
আর গিধনির পুজোয় প্রত্যেক স্পেশাল কিছুর জন্য অপেক্ষা করে। বিনপুর পল্লী কাব ৪৮ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘মিশর’। সাড়ে সাত হাজার বর্গফুট এলাকা জুড়ে মিশর সভ্যতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। মণ্ডপ প্রাঙ্গে বিভিন্ন মিশরে দেব-দেবীর মূর্তি ও সমাধি স্থান দেখতে পাওয়া যাবে। পুজোর পাশাপাশি প্লাস্টিক মুক্ত এলাকা গড়ে তোলার বার্তা দেবেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। আবার গোপীবল্লভপুর-১ ব্লকে পুজো কমিটিগুলির একে অপরের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হয়েছে। গোপীবল্লভপুর থানা সর্বজনীন ৭৫ তম বর্ষে পুজোর বাজেট ১৪ লক্ষ টাকা। প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীতে পুজোর থিম ‘পর্বত ধাম’। এবার থিম এলাকার মানুষের বিশেষ নজর কাড়বে পুজো কমিটির উদ্যোক্তারাদের দাবি। পাহাড় ও পবর্তের দুর্গম পথের মধ্যে দিয়ে মানুষ গণ্ডপি প্রবেশ করবেন। পাহাড়ের গুহার মধ্যে দেবী দুর্গার অবস্থান। পাহাড় ও পবর্তের জীব বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে এখানে।
পাহাড় পবর্তের মধ্যে বরফের উঁচুতে থাকছে শিবলিঙ্গ। এখানে দেখা যাবে ১৬ হাতের দেবী দুর্গা। পাহাড়-পর্বতের মধ্যে ঢুকলে মানুষজন বিভিন্ন জীবজন্তুর আওয়াজ শুনতে পাবেন। বৈষ্ণব মতে দেবী এখানে পূজিত হবে। আশুই সর্বজনীন দুর্গোৎসব ২১ তম বর্ষে পুজোর থিম ‘বন্যা কবলিত কেরলের কিছু অংশ’। পুজোর বাজেট ৬ লক্ষ টাকা। মণ্ডপটি তৈরি করা হচ্ছে বাঁশ, কাপড়, থার্মোকল দিয়ে প্যান্ডেল তৈরি করা হচ্ছে। প্যান্ডেলের ভিতরে প্রবেশ করলে বন্যা কবলিত এলাকা দেখতে পাবেন মানুষজন। মণ্ডপের বাইরে ৫০০ মিটার জুড়ে পর্যন্ত থাকছে বাহারি আলোকসজ্জা। আলোকসজ্জার মাধ্যমে কন্যাশ্রী, সেফ ড্রাইফ, সেফ লাইফ সহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প মানুষজন দেখতে পাবেন। নয়াবসান সর্বজীনন দুর্গোৎসব ১৭ তম বর্ষে পুজোর বাজেট ৮ লক্ষ টাকা। স্বর্নমন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি করা হচ্ছে। বাঁশ, থার্মোকল ও সোনালী কাপড় দিয়ে মণ্ডপটি তৈরি করা হচ্ছে। মণ্ডপের ভিতরে ঢুকলেই দেখা যাবে বাঁশ ও পাটকাঠির তৈরি হস্তশিল্পের তৈরি জিনিসপত্র দেখা যাবে। প্রতিমায় থাকছে বিশেষত্ব। পাটকাঠি ও সুজি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে প্রতিমা। শাশড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব এবার ৬০ তম বর্ষ। স্থায়ী মণ্ডপে পুজো হয় এখানে। সাবেকী প্রতিমার সঙ্গে মানানসই আলোকসজ্জা। চারদিন ধরে ম্যাজিক শো, বাউল, ঝুমুর ও যাত্রাপালা হবে।
https://youtu.be/JBTwdFcXyL4