কল্যাণী : যৌনজীবন সম্পর্কের বিজ্ঞান-সম্মত ধারনার অভাব, অসংযত জীবন-শৈলী, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাষ, সংক্রমনজনিত রোগের গৌণফল, ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, সল্য-চিকিতসার ত্রুটি, মোবাইল বা ল্যাপটপের অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহার, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ ইত্যাদি নানাবিধ কারনে বাঙালীর জীবনে এক ক্রমবর্ধমান সমস্যা বন্ধ্যাত্ব। সন্তানহীনতার কারনেই দাম্পত্য জীবনের শান্তি আজ অনেক সংসারেই বিঘ্নিত। বিশেষত অনেক মহিলারই জীবন বিপন্ন মাতৃত্বের অপুর্ণতার যন্ত্রণায়। ভুক্তভোগী ব্যতীত নিঃসন্তান জীবনের যন্ত্রনা হয়তো অনেকেই কল্পনার অতীত।
শুক্রানু অপর্যাপ্ততা/অসক্রিয়তা, ডিম্বানুর সংখ্যাগত বা গুণগত সমস্যা, নিষেকের সমস্যা, হর্মোনাল সমস্যা, নিষেকোত্তর ধারন ক্ষমতার সমস্যা ইত্যাদি বহুবিধ কারনেই রূদ্ধহয় মাতৃত্বের গতিপথ! প্রকট হয় বন্ধ্যাত্ব সমস্যা। প্রতিটি সমস্যার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও ফল কিন্তু একই–সন্তানহীনতা।
নিঃসন্তান নারীকে মাতৃত্বের স্বাদ দেওয়ার প্রথম স্বপ্নটা দেখেছিলেনও এক কৃতী বাঙালী বিজ্ঞানী। ডাঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের অজ্ঞানতায় অপবাদের স্বীকার হয়ে আত্নহত্মার পথ বেছে নিতে হয়েছিল তাঁকে! কিন্তু তাঁরই আবিস্কৃত পথে নলজাতকের জন্ম সুনিশ্চিত করার প্রক্রিয়া আজ সারা বিশ্বে অনুসৃত।
এরপর বিশ্বের বিভিন্ন শহরের মত কলকাতাতেও সফলভাবে জন্ম হয়েছে বহু নলজাতকের। কিন্তু গ্রাম বাংলার ছাঁ-পোষা মানুষের সন্তানহীন জীবনের অতৃপ্ত বাসনা পুরনে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি তেমন কোনো চিকিতসককেই। কারনটাও দুর্বোধ্য নয়। সাধারন মধ্যবিত্ত সংসারে ঐ বিপুল অর্থ খরচ করা সহজসাধ্য নয়। বিপুল অর্থ খরচের পরও নিশ্চিত নয় সাফল্য। তাই গরীব বন্ধ্যার ঘরে অধরা মাতৃৃত্ব!
কিন্তু এই তিমিরেও আলো দিশা দেখিয়েছেন আবার এক বাঙালী গবেষক ডাঃ সৌগত কুমার বর্মন। বন্ধ্যাত্ব সমস্যার নিরসনে যাঁর গবেষনা বর্তমানে দেশে-বিদেশে সমাদৃত। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের সুবিধার্থে কৃষ্ণনগরের মত প্রত্যন্ত শহরে তৈরী করেছেন নিজস্ব পরীক্ষাগার–‘আত্মজা’। যা আত্মর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে ইতিমধ্যে। গত দেড়-দশক ধরে প্রসূতিদের উপরে হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্ত ফলকে তাঁর গবেষনাপত্রে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বিশেষ স্বীকৃতি ও সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছেন এই বাঙালী গবেষক। একের পর এক বন্ধ্যাত্ব সমস্যা নিরসনের অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যে ইন্টারন্যাশানাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রসুতিবিভাগে ডাঃ বর্মণের সল্য বিদ্যায় অসাধারণ নৈপুন্য ও গর্ভধারণে সমস্যাগ্রস্ত রোগিনীদের মাতৃত্ব নিশ্চিত করণের ঘটনা ইতিমধ্যে সারাদেশে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত জরায়ুর অস্ত্রপোচার বা হাইরিস্ক প্রেগন্যানসির ক্ষেত্রে তার কর্মকুশলতায় সমস্যাগ্রস্ত রোগিনীদের কলকাতার বদলে কল্যানীতেই প্রসব সম্ভব হচ্ছে। IVF(Test-Tube Babu), IUI, শুক্রানু সমস্যা-ইত্যদির ক্ষেত্রেও তাঁর হাতে যেন যাদুর স্পর্শ! এর আগে কল্যানী জে.এন.এম. হসপিটালে ক্যান্সার আক্রান্ত জরায়ুতে সন্তান বড় করে সফলভাবে প্রসব করিয়ে বা অসহায় মহিলার লাইগেশন খুলে (খালি চোখে যন্ত্রছাড়াই) পুনর্মাতৃত্ব দিয়ে সংবাদের শিরোনামে এসেছিলেন এই ডাক্তারবাবুই।
অনেক চেষ্ঠার পর চাকদহে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সি.বি.ডি.এ.’-তে সাক্ষাত মিলল এই ছোটখাট চেহারার সৌম-সুন্দর বাঙালী গবেষকের। তাঁর কাছেই জানা গেল, বন্ধ্যাত্ব সমস্যার নিরসনে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে সেমিনার করছেন গ্রামে-গঞ্জে। সচেতনতা শিবিরের মাধ্যমে গ্রামীন মহিলাদের সঠিক নির্দেশনা দিতে চেষ্ঠা করছেন। ইতিমধ্যেই পার্শ্ববর্তী এলাকার বেশকিছু মহিলাকে বন্ধ্যাত্বের সমস্যা মুক্ত করে মাতৃত্বের দিকে এগিয়ে দিতে পেরেছেন। এমনকি বিবাহের 23 বছর পরও নিঃসন্তান দম্পতিদের নিষেকে সাফল্য পেয়েছেন। তিনি আরও জানালেন, আই.ভি.এফ(টেস্টটিউব বেবী), আই.ইউ.আই ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যয়বহুল হওয়ায় সকলের পক্ষে এই সকল পদ্ধতি অনুসরন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই, তিনি নিজস্ব পরীক্ষাগারে নিজস্ব গবেষণার সুবাদে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, তারই ভীত্তিতে কিছু ঔষধ, কিছু পথ্য ও যৌনজীবনের পদ্ধতিগত ঋতুগত ও সময়গত কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েই সাফল্য পাচ্ছেন! নিঃসন্তান দম্পতির কোলে সন্তান তুলে দেওয়ার আনন্দের কাছে পরাজিত হয়েছে ক্যারিয়ারের অনেক আকর্ষনীয় প্রলোভন। ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব শাপমোচনই তাঁর নেশা, তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত।