একটা মুহূর্তের জন্য…

কিছুদিন আগে আমার বন্ধু দেবাশিস মুখোপাধ্যায় আমাকে একটা ছবি উপহার দিয়েছে। দেবাশিসের আরও একটা পরিচয় রয়েছে, এই সুভদ্র, সজ্জন মানুষটি একই সঙ্গে বিখ্যাত সত্যজিৎ বিশেষজ্ঞ ও সুলেখক এবং আজকাল কাগজে আমার সহকর্মী। ছবিটা দেখে তো আমি অবাক- আরে এতো আমি! রেড রোডে ঈদের নামাজের ছবি তুলছি। একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তায় জমা জলে নামাজরত মানুষের ছায়া পড়েছে। এই অসামান্য মুহূর্তটিকে ধরে রাখার সামান্য চেষ্টা করেছিলাম, সেই ছবি। ২৫.৩.৯৩এ আজকালে প্রকাশিত সেই ছবিটি আলোকচিত্রীর নাম কুমার রায়। বাংলার সেরা চিত্রসাংবাদিকদের একজন কুমার। পরিশ্রমী ও বিনয়ী, ওর কাজ আমার খুব ভাল লাগে। দেবাশিস জানালো, ছবিটা ছাপা হয়নি বলে কুমারের খুব অভিমান হয়েছিল। আমি সেসময় ছবিটা ওর কাছ থেকে নিয়ে রেখে দিয়েছিলাম, তখনও জানতাম না, এটা তুমি। আমার ভাল লেগেছিল বলেই ছবিটা রেখে দিয়েছিলাম, তার চেয়েও বড় কথা রিফ্লেক্ট করে কীভাবে ছবি তুলতে হয় তা শেখার জন্য। কুমারকে জিজ্ঞেস করায় ও বললো, অশোকদা, এটা আজকালে ছাপা হয়েছিল, আমার খুব প্রিয় ছবি তুমি কোথায় পেলে? দেবাশিসকে একথা জিজ্ঞেস করায় সে জানালো, বেরিয়েছিল কিনা তার তা মনে নেই।

যাইহোক কুমার ও দেবাশিসকে ধন্যবাদ। ছবিটা আমাকে মনে করিয়ে দিল অনেক পুরনো দিনের কথা। মনে পড়লো, ছবি তোলার জন্য তখন আমি কত কি করতাম! মজাও লাগছিল ছবিটা তোলার পর জামাকাপড়ের অবস্থা কী হয়েছিল তা ভেবে! ছবিটা দেখে প্রবল নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম। আমার ছোট ছেলে পিকু ছবিটা দেখে বললো, ‘আর ইউ ম্যাড?’ এভাবে কেউ ছবি তোলে? ওর মা পাশ থেকে টিপ্পনী কাটলো, ‘তখন হাফ ছিল, এখন ফুল’। হাফ না ফুল জানিনা আমার জার্নিতে অনেক কিছুই এসেছে আবার চলেও গেছে। সেই সময়টা এমনই ছিল। একটা ছবির জন্য সবকিছু করতে পারতাম। আগে পরে কিছু ভাবতাম না। আমার কম বয়সী বন্ধুদের দেখে সে দিনগুলির কথা মনে পড়ে। দারুণ সব কাজ করছে তারা।

দীর্ঘ দিন চিত্রসাংবাদিকতা করার সময় একজনের ছবি বেশি তুলতাম। খুব ভেবে তুলতাম তাও নয়, তবুও তাকে ফলো করতাম। তার প্রতিটি ছবিতেই থাকতো অসংখ্য বৈচিত্র। ছবি তুলতে তুলতেই বুঝেছিলাম, ইনি সাধারণ নন। এর ভেতরে আছে এক অন্যরকম শক্তি। কখনও ইনি হয়ে যান মা, কখনও মেয়ে, কখনও বা বন্ধু। হাসি-কান্না-ভালোবাসা-সাহসের এক আলোছায়া যেন একের পর এক তার চলনে বলনে খেলা করে যায়। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! ঠিক করে নিলাম আমি এর ওপর ছবি তুলেই যাবো। দেখি কোথায় গিয়ে তা শেষ হয়। একটুও বাড়িয়ে বলছি না- সেসময় কংগ্রেস বা সিপিএমের নেতাদের সঙ্গে আমার এনিয়ে তর্ক বিতর্কও হয়েছে। তারা আমায় গালমন্দও কম করেনি, জুটেছে সাংবাদিক বন্ধুদের উপহাস। তবুও আমি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে কাজ করে গিয়েছি। একাজ করতে গিয়ে ঝামেলা, মারধর, শাসানি ও পুলিশের লাঠির কথা আর আলাদা করে বলছি না। পুলিশের লাঠিতে মাথা ফাটিয়ে পিজিতে ভর্তি হয়েছিলাম আবার রডন স্কোয়ার নিয়ে বিক্ষোভের সময় মার খেয়েছি কমরেডদের হাতে। আমার সবসময় কেন জানি মনে হত, এই মহিলা একদিন এক অন্যরকম জায়গায় পৌঁছবেন।

আমার বাবা রেলে কাজ করতেন, হাওড়ার বামুনগাছি রেল কোয়ার্টারে আমরা থাকতাম। পরে কাজের সুবিধার জন্য আমি চলে এসেছিলাম কলেজ স্ট্রিটে বসন্ত কেবিনের একটা মেসে। মেসের খাবার ভাল লাগতো না। মায়ের হাতের চুনো মাছের ঝাল, লাউ- চিংড়ি, ডিম পোস্ত খাওয়ার লোভে মাঝে মধ্যে বাড়ি চলে যেতাম। রাত কাটিয়ে পরেরদিন আবার ফেরা। ২০০১সালে ভোটের আগে মা-র সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়ি গিয়েছি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ মা আমায় বলে বসলো, এই মেয়েটার কাছে আমায় একদিন নিয়ে যাবি? ওকে একদিন দেখবো। বিশ্বাস করুন, ক্লাস থ্রি অবধি পড়া আমার মা-র সঙ্গে রাজনীতির কোন যোগাযোগ নেই। রাজনৈতিক নেতা বলতে মা শুধু শুনেছে ইন্দিরা গান্ধীর নাম, কাগজে ছবিও দেখেছে। তাও বাবা খবরের কাগজ পড়তো আর মা শুনতো। কাগজে ইন্দিরার ছবি দেখে তার মন্তব্য, দেখতে খুব সুন্দর। মা জীবনে খুব একটা বাড়ির বাইরে বেরোয়নি। সেই মা বলে কি না, কী সাহস! এত মার খায়, তবুও ওকে দমানো যায় না, মেয়েটাকে দেখবো। সাদা কালো টিভির পর্দায় মা এরমধ্যেই তার মার খাওয়ার ছবি দেখে ফেলেছে। মা বলেছিল, দেখবি মেয়েটা একদিন…

পরেরদিন আনন্দবাজারে ঢুকেই কাঁচের দরজা খুলে সোজা বার্তা সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে ঢুকে মা-র এই কথাটা বলি। বললাম, আমার মা যদি এই কথাটা বলে তাহলে বুঝতে পারছো, এই বাংলার আরও কত মা তার কথা শুনতে চায়, তাকে দেখতে চায়। সুমনদা আমাকে বলেছিল, অশোক তুই ইতিহাসের ছাত্র না, ইতিহাসের ধার ধারিস না, মূর্খ, তবুও এই কথাটা যা বললি তা সত্যি অসাধারণ ভাবার ব্যাপার। চল, এবার ইলেকশনটা তুই আমি দু-ভাই মিলে গ্রাম বাংলায় ঘুরবো। আমার সৌভাগ্য যে, সুমনদা সেবার প্রায় গোটা ইলেকশন কভারেজটা আমায় নিয়ে করেছিল। এটাও বলতে হবে সেবার সাদা বাড়ি কালো গ্রিল এর মালিক ও সম্পাদক তাকে পিছন থেকে অনেকটাই সাপোর্ট দিয়েছিলেন। যদিও তিনি সেবার ক্ষমতায় আসতে পারেন নি।

আজ বিশ্ব সাংবাদিক দিবস। আমার সাংবাদিক বন্ধুরা কলকাতা, দিল্লি নানা জায়গায় আলোচনা, প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে দিনটি পালন করেন। আমিও দেখতে যাবো। সত্যি তারা ফটোগ্রাফিকে ভালবেসে এখনও কাজ করে চলেছেন। তাদের সবাইকে ভালবাসা, শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন। কিন্তু এই বিশেষ দিনে আমি একজন নারীর কথা আলাদাভাবে বললাম কেন তা নিয়ে অনেকে অনেকরকম ভাবে ব্যাখ্যা করবেন। কিন্তু জেনে রাখুন আমি আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই নারীকে ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাবো। তিনিই এখন আমার ছবির প্রধান সাবজেক্ট।

দীর্ঘদিন ধরে আমি তার সঙ্গে আছি। এমন রাজনৈতিক চরিত্র আমি এর আগে কখনও দেখিনি। তার কাজকর্মের একটা বিশ্বস্ত ডকুমেন্টেশন করার চেষ্টা করছি। সময় সুযোগ পেলে আমি নিজেই তা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো। বহু মানুষ, বন্ধুবান্ধব, গুণীজন, সরকারি আমলা সবাই বলেন, কবে বই প্রকাশ করবো বা প্রদর্শনী হবে? এতো ভাবিনা। ২০১৯- ২০২১ সালের পর কিছু একটা ভাবা যাবে।

আমি এতক্ষণ যাকে মহিলা, নারী বলে এলাম,তার নাম আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। হ্যাঁ, তিনি হলেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমাদের সবার দিদি। আমার মা অর্চনা মজুমদার ২০০১সালে যাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি শুধু বাংলায় নন, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। দিদি তো মায়ের মতো। দিদি মমতার সঙ্গে মা অর্চনার একটা ছবি তোলার ইচ্ছে রয়েছে। দিদি অনুমতিও দিয়েছেন। মা সুস্থ হলে একটা ছবি তুলবো। আর এই ছবিটা হবে এক ইচ্ছাপূরণের গল্প। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার গল্প। এক মায়ের ইচ্ছাপূরণের গল্প, নিষ্ঠা ও চেষ্টার মধ্যে দিয়ে এক দিদির সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানোর গল্প। দুটি জীবনের সার্থক হওয়ার গল্প। আমার স্বপ্নও সার্থক হওয়ার গল্প।

দিবস নয়, সময় নয় ছবি, আদতে শুধু একটা মুহূর্তকেই ধরে রাখতে পারে। এই ছবিটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তটাকে ধরে রাখবে।

এবারবাংলা এক্সপ্রেসআপনার মোবাইলে, ডাউনলোড করুন বাংলা এক্সপ্রেস ফ্রি মোবাইল অ্যাপ 

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

রবীন্দ্র সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শনিবার রাতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে

কলকাতা, ১৬ নভেম্বর ২০২৪:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে আগামী শনিবার রাত থেকে রবীন্দ্র সেতু…

2 days ago

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

3 days ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

3 days ago

বিহারের জামুইতে ভগবান বীরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনজাতীয় গৌরব দিবসে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের জামুই জেলায় জনজাতীয় গৌরব দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে…

3 days ago

২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আগামী ২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। ঐ একই দিনে নান্দেথ…

4 days ago

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তায় ‘সরস মেলা’র উদ্বোধন করবেন ।আগামীকাল তিনি যাবেন…

4 days ago