ছোট গাড়ি, বড় দৌড়…

ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে দেখেছিলাম জগদ্দল নামে লজঝড়ে গাড়িটি একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে। সোলারিও নামে যে ছোট গাড়িটিতে চড়ে দিদি গোটা দিল্লি চষে ফেলেন সেই গাড়িটিও যেন হয়ে উঠেছে গোটা দেশের রুদ্ধ্বশ্বাস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ছোটখাটো চেহারার এক আটপৌরে মহিলাকে নিয়ে সেই ছোট গাড়ি কখনও ছুটছে সোনিয়া-রাহুলের বাড়ির দিকে, কখনও বা তা চলে যাচ্ছে দেবগৌড়ার বাড়ি আবার একটু পরেই তা পাড়ি দিচ্ছে সংসদ ভবনের দিকে। কলকাতার রাস্তার মতই এখানেও দিদির কোন পাইলট কার নেই। কলকাতা থেকে নিরাপত্তার জন্য দুটো গাড়ি আর দিল্লি পুলিশের একটা গাড়ি। দিল্লির জ্যামে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িও আটকে থাকে। হুটার বাজানো নিষেধ। তাকে আটকাবে কে? গাড়ির ভিতরে বসে থাকা আমাদের দিদিই যেন এক পাওয়ার হাউস। যার জোরে তিনি সামলাচ্ছেন বিজেপির শয়তানি যুক্তিজাল, অগুন্তি সাংবাদিকদের, ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্নবাণ, বিরোধী দলগুলির সর্বভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে রচনা করছেন বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের রণকৌশল।

এবার দিল্লিতে দিদির সফরে আমি তাকে ঘিরে যে আগ্রহ, উৎসাহ ও উন্মাদনা লক্ষ্য করলাম তা আগে কোনদিনও দেখিনি। সারাদেশের সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, সাংসদ এমনকি সংসদের সামান্য কর্মীও তাকে ঘিরে যে ঔৎসুক্য দেখালেন তাতে আমি জাস্ট চমকে গেছি। সত্যি বলতে কী আমার খুব আনন্দ হয়েছে। দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে বাংলার কোন নেতাকে এতটা গুরুত্ব পেতে, তাদের সামনে এত মানুষ জড়ো হতে আমি কোনদিন দেখিনি। পশ্চিমবঙ্গের নেতাদেরও নয়, জাতীয় রাজনীতিতে আসা বাংলার কোন নেতাদেরও নয়।

জ্যোতিবাবুর আমল থেকে আমার চিত্রসাংবাদিকতার শুরু। যতটা দেখেছি কিংবা সহকর্মীদের কাছে জেনেছি যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীরা দিল্লিতে কিছু বিশেষ মিটিং ছাড়া আর কিছুই করতেন না। এব্যাপারে জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবু সবাই এক। তাদের যাবতীয় কেন্দ্র বিরোধিতা দিল্লি গিয়ে কেমন যেন চুপসে যেত। রাজ্যে ফেরার পর আবার তারা বিপ্লবী হয়ে উঠতেন। পরবর্তীকালে ঢাকে ঢোলে বেজে উঠল জ্যোতিবাবুর নাকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা একেবারে পাকা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু দলের বিরোধিতায় নাকি হতে পারেননি। বঙ্গীয় বামপন্থীরা এনিয়ে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ ইত্যাদি বলে ব্যাপক মরাকান্না জুড়লেও জাতীয় রাজনীতিতে তা নিয়ে খুব একটা হৈচৈ হয়নি। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর প্রণববাবুর প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে আমরা শুনেছিলাম। কিন্তু দিল্লির রাজনীতিতে এই রটনার সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও দেখিনি। আসলে বাংলার নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে কখনোই তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি। বস্তুত স্বাধীনতার পরেই বাংলার নেতাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল। বিধান রায়, অতুল্য ঘোষদের আমলের পর তা একেবারেই শেষ হয়ে যায়। আর দিল্লিতে সিপিএমের যে দুটি মুখ ছিল সেই ইয়েচুরি-কারাতদের রাজ্য কিংবা কেন্দ্র কোন জায়গাতেই কোন শিকড় ছিল না। এরা দুজনেই চালাক চালাক পার্টি ম্যানেজার।

এই ছবিটা দিদি একেবারে বদলে দিয়েছেন। কথা ছিল দিল্লি পৌঁছে সাড়ে বারোটা নাগাদ দিদি সংসদ ভবনে ঢুকবেন। তার বহু আগের থেকেই সেখানে গোটা দেশের সাংবাদিকদের ভিড়। দিদির দীর্ঘদিনের সঙ্গী রতন মুখার্জির চালানো সোলারিও ভিতরে ঢুকতেই চারদিক থেকে সেই গাড়ি ঘিরে নিলেন সাংবাদিকরা। সবাই তার সঙ্গে কথা বলতে চান। কোনভাবে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে সবাইকে অফিসে আসতে বললেন তিনি। এরপর তার পিছনে ছুটল ভিড়। ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে যেতে দেখলাম আমার চেনা বহু হাড্ডাগাড্ডা চেহারার চিত্রসাংবাদিকদেরও। সংসদ ভবনের ভিতরে তৃণমূলের অফিসে ঢুকে দেখি তিল ধারণের জায়গা নেই। সংসদ কভার করা সাংবাদিকরা দিদিকে ঘিরে নানা প্রশ্ন করছেন, আর তিনি হাসি মুখে সবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। সংসদের ভিতরে নানা দলের নেতাদের দিদির সঙ্গে কথা বলতে দেখলাম। আর তার ভিতরেই এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেওয়ার আব্দার।

তাদের সামলে দিদি ভিড় ঠেলে চলে গেলেন আদবানিজীর ঘরে। তাকে প্রণাম করে কথা বলে ঢুকলেন সেন্ট্রাল হলে। ব্যাস, আর আমি দিদিকে দেখতে পাচ্ছি না। তিনি ভিড়ে হারিয়ে গেছেন। ভিড় দেখে আন্দাজ করলাম ওখানেই আছেন দিদি। প্রবেশ নিষেধ, দরজার বাইরে থেকে এ দৃশ্য দেখা ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। আমি ঠিকই করে নিয়েছিলাম ক্যামেরা নয়, এবার দিদির দিল্লি সফর দেখবো চোখ দিয়ে। দেখলাম এই অদ্ভুত ম্যাজিক এখন দেশের কোন রাজনৈতিক নেতার নেই। রাস্তা, প্রেসক্লাব, সংসদ সব জায়গাতেই আসাম সমস্যা থেকে শুরু করে যে কোন সমস্যাতেই সবার এক প্রশ্ন, ‘মমতা ব্যানার্জি ক্যা করেগা’? দিল্লির প্রেসক্লাবে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ওদেরও দিদি সম্পর্কে নানা প্রশ্ন। জগদীশ প্রেম তো বলেই বসলো, ‘দিদি কো আভি প্রধানমন্ত্রী করনাই হোগা’। হাসি ছাড়া এ প্রশ্নের আর কী উত্তর দেবো?

বস্তুত তিনিই এখন গোটা দেশ জুড়ে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান মুখ। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে বিরোধী রাজনীতি। তার চারপাশেই সবচেয়ে বেশি সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যমগুলির সাংবাদিদের ভিড়। আবার তিনি মোদী-অমিতদের যাবতীয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রধান লক্ষ্য। জাতীয় রাজনীতিতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই গুরুত্ব বাঙালি হিসেবে আমাকে গর্বিত করেছে। এবারে দিদির সঙ্গে দিল্লি সফরে আমি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছি ছোট সোলারিও গাড়িতে দিদির যাত্রা মোটেই ছোট হবে না। আরও অনেক, অনেক দূর পৌঁছবেন তিনি। আমি ভাবছিলাম দিদির কালীঘাটের টালির চালের বাড়িটার কথা। বৃষ্টি হলে বা আদিগঙ্গায় বাণ এলে সে বাড়িতে জল ঢুকতো। দিদির মা বেঁচে থাকার সময় দেখতাম সেই জলবন্দী অবস্থায় খাটে বসে মার সঙ্গে গল্প করছেন দিদি। কখনও দিদি বা মাসিমার কোলে থাকতো ছোট্ট অভিষেক। সেই বাড়ি থেকে নিজের চেষ্টা, নিষ্ঠা আর সংগ্রামের রাস্তা ধরে উঠে এসে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এও তো এক লগ কেবিন টু হোয়াইট হাউসের গল্প। আমাদের দিদি এখন হয়ে উঠেছেন গোটা দেশের আম আদমির মুখ। তাকে সামনে রেখে গোটা দেশের দুঁদে রাজনীতিবিদরা বিজেপিকে হারানোর রণকৌশল রচনা করছেন। এক জীবনে এও কী কম পাওয়া! ছোট গাড়ির এই বড় দৌড়ের দিকে এখন গোটা দেশ তাকিয়ে আছে।

Satwajit Mondal

Share
Published by
Satwajit Mondal

Recent Posts

আন্দোলনের নামে পুড়ে ছাই বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড “জলের গান”

'বকুল ফুল বকুল ফুল সোনা দিয়া হাত কেন বান্ধাইলি/ শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক…

2 months ago

বাংলাদেশ : মাথায় রাখতে হবে ঘুমন্ত সব রা*ক্ষস এখন জেগে উঠবে

মুহাম্মদ হোসাইন: একটা বিষয় পরিষ্কার বলে দেই। পাবলিক ভার্সিটির কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সাধারণ জনগনের…

2 months ago

ছেলের হাতে খুন “মা”, ঘটনার জানাজানির পর এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য

ছেলের হাতে মা খুন, প্লাস্টিক মুড়ে বাড়ির মধ্যেই ফেলে রাখলো ছেলে। রাতেই মহিলার রক্তাক্ত দেহ…

3 months ago

AIIFA টেকসই স্টিল উৎপাদক সমিতি কলকাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সভার আয়োজন করলো

কলকাতা: এআইআইএফএ টেকসই স্টিল উৎপাদক সমিতি, যা সেকেন্ডারি স্টিল শিল্পের অনন্য কণ্ঠস্বর, আজ কলকাতার দ্য…

3 months ago

মগরাহাটে গুলিবিদ্ধ ব্যবসায়ী, ৭ লক্ষ টাকা লুঠ

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মগরাহাটে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে সর্বস্ব লুট করে চম্পট দুষ্কৃতী দলের।…

4 months ago

২১ জুলাইয়ের প্রস্তুতি শুরু, সভাস্থল পরিদর্শনে তৃণমূল নেতারা

শুধু শহীদ স্মরণ নয়, লোকসভা নির্বাচনে বিরাট সাফল্যের পর রাজ্যবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর সমাবেশ। একুশে জুলাই…

4 months ago