ভালো থাকবেন রমাপদ দা..

ছোটবেলায় বাবা মার সঙ্গে একটা বই দেখেছিলাম, দ্বীপের নাম টিয়ারঙ। তখন সিনেমাকে বই বলা হত। আর সেসময় ছবি হিট হত কাহিনীর জোরেই আর সেই কাহিনী আসতো রমাপদ চৌধুরীদের মত লেখকদের কলম থেকেই। আজ সকালে খবরের কাগজ পড়ে জানলাম বইটার লেখকের নাম রমাপদ চৌধুরী। আনন্দবাজারে চিত্রসাংবাদিকতা করার সূত্রে দীর্ঘদিন তাঁর সহকর্মী ছিলাম। সেখানকার অন্যান্য লেখক ও কথাসাহিত্যিকদের সঙ্গে ঘনিষ্টতাও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে তেমন কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বরং তাঁকে খানিকটা ভয়ই করতাম। মিতবাক মানুষটির স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ও নির্লিপ্তির পাঁচিল ডিঙনো সত্যি বেশ কঠিন ছিল। এবং এই ব্যাপারটা সারা জীবন তিনি বজায় রেখেছিলেন।

এটা কোন আরোপিত লোকদেখানো ব্যাপার নয়, এটাকে অহংকারও বলা যাবে না। বরং তা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কম কথা বলার সঙ্গে সঙ্গত করত তাঁর কম লেখা। অতিপ্রসবের রাস্তায় তিনি কোনদিনই হাঁটেন নি। এটা তাঁর সম্পর্কে আমার সম্ভ্রম আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবতাম, এর সামনে ভুলভাল কথা বললে ধমক খেতে হবে। আমার পড়াশুনা বরাবরই কম, তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কোন কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। দু একটা উপন্যাস ও গল্প পড়েছি। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম থেকে তৈরি হওয়া সব সিনেমাই আমি দেখেছি। বনপলাশীর পদাবলী তো বটেই তাছাড়া এখনই, খারিজ, এক ডক্টর কি মওত, এক দিন অচানক সব ছবিই আমার দেখা। তাঁর লেখা আমাদের চারপাশের জীবনের চেনা গল্প। পাত্রপাত্রীরাও আমাদের চেনা মানুষ। শুধু তাদের দেখার আর বোঝার দৃষ্টিকোণটা আলাদা। এটাই রমাপদ চৌধুরীকে অন্য লেখকদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে।

এই দেখা ব্যাপারটা মনে পড়তেই আমার একটা ছবির কথা মনে পড়ল। আনন্দবাজারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দুজন বিখ্যাত মানুষ ধুতি পাঞ্জাবি আর পায়ে সাধারণ চটি পড়ে সিগারেট খেতেন, কখনও বা চা। এদের একজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আরেকজন রমাপদ চৌধুরী। আগুন লাগার পর থেকে আনন্দবাজারের ভিতরে সিগারেট খাওয়া তখন বারণ হয়ে গেছে। রমাপদ দাকে দেখতাম চারপাশের লোকজনকে নিবিষ্টভাবে লক্ষ্য করছেন। তখন আমি আনন্দবাজারের কলকাতা পাতার জন্য একটা বিশেষ ছবি তুলতাম। প্রায়ই আমার চোখে পড়ত এই দৃশ্য। নীরেন দা লম্বা এবং রমাপদ দা ছোটখাটো মানুষ, তাই নীরেন দা তাঁর সঙ্গে একটু ঝুঁকে কথা বলতেন। দুজনের আড্ডায় আমি কিন্তু কোন তৃতীয় ব্যাক্তিকে কোনদিন দেখিনি। এই দৃশ্যের একটা ছবি তুলেছিলাম, কিন্তু তা ছাপা হয় নি। আমার মতে ছবিটা ছাপা উচিৎ ছিল। যাইহোক গতকাল রাত থেকে বহু খোঁজার পরও ছবিটা পেলাম না। বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রঘুবীর সিং একবার আমায় বলেছিলেন, ছবি তোলার চেয়েও তা যত্ন করে সংরক্ষণ করা আরও বেশি কঠিন। এখন তা প্রতি পদে বুঝতে পারছি। দিদির সঙ্গে দিল্লি আসার তাড়ায় আর বেশি খোঁজার সময় পাইনি। ইচ্ছে ছিল এই লেখাটার সঙ্গে ছবিটা পোস্ট করবো, কিন্তু তা আর হয়ে উঠল না।

নীরেন দার সঙ্গে কথা বললেও রমাপদ দার সঙ্গে আমার মনে রাখার মত কোন কথাই হত না। কারণ তো আগেই বলেছি। রমাপদ দা অফিসেও খুব একটা কথা বলতেন না। কোনদিন তাঁকে যেচে কারও সঙ্গে কথা বলতেও দেখিনি। দেখা হলে হাসতেন। সারাক্ষণ আপন মনে থাকতেন কিন্তু ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবি আর কোলাপুরি চটি পড়া রমাপদ দাকে আত্মভোলা মানুষও বলা যাবে না। আনন্দবাজারে রবিবারের পাতায় কয়েকটা কিস্তিতে তাঁর জ্যোতিষ সংক্রান্ত লেখাগুলি যারা পড়েছেন তারা তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি জালের পরিচয় পেয়েছেন। লিফটে কয়েকবার দেখেছি গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজছেন। লিফটে একবার আমার ক্যামেরাটা দেখে বলেছিলেন, এই ক্যামেরাটার অনেক দাম তাই না? ব্যস এটুকুই, এর বেশি আর কথা এগোয় নি।

ওপরের ঘটনাটা ধরলে রমাপদ দার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে মোট তিনবার। আরেকদিন বৃষ্টির সময় আরও অনেক মানুষের সঙ্গে তিনি গেটে দাঁড়িয়েছিলেন। গাড়ি এসে গেলেও বৃষ্টির দাপটে গাড়িতে উঠতে পারছিলেন না। আমিও তখন বেরোচ্ছিলাম, বললাম, রমাপদ দা চলুন আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসি। একটু হেসে তিনি আমার ছাতার তলায় এলেন। গাড়িতে উঠিয়ে দিতেই বললেন, তুমি কোথায় যাবে? গাড়িতে উঠে এস। আমি বললাম, আমি কাজে যাব, ডিপার্টমেন্টের গাড়ি আছে। আরেকদিন দেশের ঘরে সুনীল দাকে একটা ছবি দিতে গিয়ে দেখি সবাই মিলে মুড়ি, বাদাম, ছোলা খাচ্ছেন। শীর্ষেন্দুদাও ছিলেন। তিনি আমায় দেখেই বললেন, অ্যাই ছেলে, মুড়ি খাও। উনি না দেখলেও আমি ওকে দেখতাম আর দেখতাম। চোখে চোখ পড়লেও দেখেছি রমাপদ দা কেমন যেন একটা অন্য জগতে থাকতেন।

মার্ক জুকেরবার্গের কল্যাণে আমার রমাপদ চৌধুরীর মত একজন কথাশিল্পীকে নিয়ে দু চার কথা লেখার সুযোগ হল। রমাপদ দার সঙ্গে আগাগোড়া যোগাযোগ ছিল সিদ্ধার্থ সিংহের। মৃত্যুর পর যে সব কবি লেখকরা ওঁর স্মৃতিচারণা করছেন, জানি না তাদের মধ্যে কজন তাঁকে দেখতে গেছেন বা খোঁজখবর নিয়েছেন। মৃত্যুর পরই এখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়া বা নানা গণমাধ্যমে ঘনিষ্টজনেদের দেখা পাই। খুব ইচ্ছে করছে নীরেন দার কাছে গিয়ে আনন্দবাজারের গেটে তাদের সেই সিগারেট আড্ডার কথা শুনতে। আপনাদের কথা দিলাম সেই আড্ডার ছবি খুঁজে বার করে আমি আপনাদের দেখাবই।

অশোক মজুমদার

Satwajit Mondal

Share
Published by
Satwajit Mondal

Recent Posts

রবীন্দ্র সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শনিবার রাতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে

কলকাতা, ১৬ নভেম্বর ২০২৪:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে আগামী শনিবার রাত থেকে রবীন্দ্র সেতু…

2 days ago

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

3 days ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

3 days ago

বিহারের জামুইতে ভগবান বীরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনজাতীয় গৌরব দিবসে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের জামুই জেলায় জনজাতীয় গৌরব দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে…

3 days ago

২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আগামী ২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। ঐ একই দিনে নান্দেথ…

5 days ago

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তায় ‘সরস মেলা’র উদ্বোধন করবেন ।আগামীকাল তিনি যাবেন…

5 days ago