প্রসঙ্গ আসাম ফেসবুকে মুসলমানের আরো মুসলিম হওয়া আর হিন্দুর আরো হিন্দু হওয়া দেখছি- মানুষ থেকে আরো উন্নত মানুষ হওয়া দেখতে পাচ্ছি না

আসামে যা ঘটছে তা নিয়ে অনেকেই লিখছেন। মনে রাখতে হবে দেশের সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এন আর সি তৈরী হয়েছে।শুধু বিজেপি দায়ী বলে দিলে তা সত্যকথন হবে না। দ্বিতীয় তালিকায় শুধু মুসলিম আছেন এই বক্তব্য ও সঠিক নয়। বহু গণ্যমান্য বাঙালির নাম এই তালিকায় নেই, তাদের একটা বড় অংশ জন্মসূত্রে হিন্দু। এই যে একটি রাজনৈতিক দল বলছে মোল্লাদের তাড়িয়েছে- এ হল ‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে’র উজ্জ্বল উদাহরণ। আজ যদি ৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে বাংলায় এন আর সি হয়, তাহলে ওপার বাংলা থেকে বিতাড়িত ও আশ্রয় প্রার্থী বহু মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে।

ইতিহাসে জনতত্ত্ব নিয়ে আমরা যত চিন্তা করি, নরতত্ত্ব নিয়ে তা করি না বলে নীহাররঞ্জন আক্ষেপ করেছেন। বস্তুত: জনতত্ত্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল কিন্তু নরতত্ত্ব পরিবর্তনে সহস্র বছর ও কম। তাই, বাঙালী বলে চিহ্নিত মানুষের ধর্মীয় পরিচয় যাই হোক নৃতত্ত্বের দৃষ্টিতে তারা ঘনিষ্ঠ। হয়ত, কয়েক শত বৎসরের ব্যবধানে আজকের শত্রুর সাথে একাসনে আহার না করতে পারলে জীবন মরুভূমি হয়ে যেত। নীহাররঞ্জন লিখেছেন- “দুর্ভিক্ষ, রাষ্ট্রবিপ্লব, দেশচ্ছেদ, প্রান্তীয় দ্বেষ ও হিংসা, চারিত্রদৈন্য, আর্থিক দুর্গতি প্রভৃতি সকল শত্রু মিলিয়া আজ বাংলাকে ও মূঢ়, আশাহত বাঙালী জাতিকে চরম দুর্গতির মধ্যে আনিয়া ফেলিয়াছে।” তাঁর মতো আমাদের সকলের এই মনস্তাপ এখন শারীরিক যন্ত্রণার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্ম বা বর্ণ যাই হোক এই বিপর্যয়ের শিকার বাঙালী। মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র জাতি যারা শুধু মাতৃভাষার জন্য একের পর এক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। বাঙালী বৌদ্ধ নেড়ে থেকে মুসলিম নেড়ে হয়েছে, ব্রাহ্মণ্যবাদের ঠেলায় অন্তঃজ ব্রতচারী বাঙালী চতুর্বর্ণের আশ্রয় নিয়েছে কিন্তু ভোগান্তির শেষ হয় নি। ভাঁড়ু দত্তরাই আমাদের ডেস্টিনির মালিক। রাজনৈতিক ওয়াহাবি ইসলামের ফাঁদে পড়া বাঙালির সব গিয়েছে। আমাদের সপ্তডিঙা নেই, সহজিয়া আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে, আমাদের অতীত গৌরব আর সম্ভ্রমবোধ কে খুন করেছি। অবলীলায় একদল ধর্মের নামে জবাই করছে, আরেক দল বদলা নিতে জবাই করতে পারছে না বলে ইংরেজ-নির্মিত বাঙালী স্টাইলে ‘ তোকে পারি নি তোর ছাকে ছাড়বো না বলে’ হুঙ্কার ছাড়ছে। তাহলে পাঁচ সহস্রাব্দ প্রাচীন এই জাতি কি শুধু যদুবংশের মত বিনাশ হওয়ার প্রহর গুনছে?

হিন্দু মুসলিমের বিভেদ যেভাবে খুঁচিয়ে তোলা হচ্ছে তা কারো জন্য ভালো হবে না। ঐতিহাসিক কারনে এই দেশে ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র সম্ভব নয়- মোদিবাবুরা যাই বলুন হিন্দুর নয়া সংজ্ঞা বেশির ভাগ হিন্দুর পছন্দ হবে না। তারা জোরে জোরে চিৎকার করলেই নিরব গরিষ্ঠ মানুষ তা মেনে নেবে এটা ভাবার কোন কারন নেই। শুধু ক্ষমতার জন্য দেশের সর্বত্র মুসলিম-হিন্দু, ছোটজাত-বড়জাত এই বিভেদে যে সামাজিক অস্থিরতা তৈরী করবে, ফেসবুকে র জানালা দিয়ে তা দেখা না গেলেও সর্বত্র তার ছাপ পড়বে।
বৈচিত্র আছে বলেই এই দেশ সুন্দর ও নিরাপদ। এই বৈচিত্র ও নিরাপত্তা না থাকলে ফেসবুকে গুড মর্নিং বা খাবারের থালার ছবি পোস্ট করার বদলে “দেখ আমি এখনো বেঁচে আছি” স্টান্স দিতে হবে। কাজেই, নিজের ব্যক্তিগত তিক্ত স্মরণ থেকে ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে সাধারণীকরন না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে দেখলে, প্রতিটি মানুষের ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যাবে। নতুন বউয়ের প্রতিটি খুঁত ধরে তার বাপের বাড়ির গঞ্জনা যেমন শুধু দাম্পত্যকে তিক্ত ও কলুষিত করে তেমনি একজনের ত্রুটি তুলে ধরে কোন সমাজকে দোষী করলে তিক্ততা বাড়বে। কারো কিছু লাভ হবে না।

ফেসবুকে মুসলমানের আরো মুসলিম হওয়া আর হিন্দুর আরো হিন্দু হওয়া দেখছি- মানুষ থেকে আরো উন্নত মানুষ হওয়া দেখতে পাচ্ছি না। ধরুন, মোদিকে দানব বানিয়ে দিদিকে জিতিয়ে আনলেন, কাল থেকে আপনার জীবনে বসন্ত আসবে? ধরুন চটি জুতো নিয়ে নোংরা রসিকতা করে মমতার বাপান্ত করলেন, কাল দিলীপ ঘোষ আপনার মুখ্যমন্ত্রী তাহলে আপনার জীবনে স্বর্গ নেমে আসবে?
নিজের ভবিষ্যত একা একা স্থির করার দিন গিয়েছে। সমাজের সুস্থিতি আর সমাজের সাম্য ও শান্তির উপর নির্ভর করছে আমাদের ভালোমন্দ। ব্যক্তিগত হতাশা, না পাওয়ার দুঃখ, তিক্ততা, অন্যের প্রতি রাগ-দ্বেষ-ঘৃণা-অপমান কোন কিছুই আমাদের অস্তিত্বের ব্যক্তিগত সঙ্কটের মহৌষধ নয়। ভবিষ্যতে আমরা সবাই মৃতদেহের স্তূপ- আজ কাল বা পরশু।
দ্বিজেন রায় ধার করে বলতে চাই- বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাঙলা শুধু মুসলমানের নয়, মিলিত হিন্দু-মুসলমানের মাতৃভূমি গুলবাগ এই বাংলা। এ যদি না বুঝতে পারি আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল বলে শুধু কাঁদতে হবে।

Satwajit Mondal

Share
Published by
Satwajit Mondal

Recent Posts

মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের কড়া নজর: পর্যালোচনা বৈঠকে অমিত শাহ

মণিপুরের ক্রমশ উদ্বেগজনক হয়ে ওঠা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গতকাল নতুন দিল্লিতে…

1 hour ago

আদিবাসী সমাজের উন্নয়ন: প্রকল্প পর্যালোচনায় মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিশেষ বৈঠক

আদিবাসী সমাজের উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলির অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের আয়োজন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা…

1 hour ago

হাওড়া-ধর্মতলা মেট্রোতে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ছে, কমছে অপেক্ষার সময়

যাত্রীদের সুবিধার্থে এবং সকাল ও সন্ধ্যার অফিসের ব্যস্ত সময়ে যাত্রী ভিড় সামাল দিতে মেট্রো রেল…

1 hour ago

রবীন্দ্র সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শনিবার রাতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে

কলকাতা, ১৬ নভেম্বর ২০২৪:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে আগামী শনিবার রাত থেকে রবীন্দ্র সেতু…

3 days ago

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

4 days ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

4 days ago