যাঁরা নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে চলেছেন শহর থেকে বহু যোজন দূরে, পাঠক যাঁদের নামই জানল না, তাঁদের মধ্যেই অন্যতম হলেন ফজলুল হক। সম্প্রতি তাঁর গল্প উপন্যাস কবিতা পাঠ করতে গিয়ে আমার বিস্ময়ের অবধি নেই। মুসলিম সমাজের ধর্মান্ধ ভণ্ডামিকে তথা আচারসর্বস্বতাকে তিনি যেমন যুক্তির আলোকে খণ্ডন করতে চেয়েছেন, তেমনি সর্বব্যাপী মানবিকতার জাগরণের বার্তাও পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। বহু সাহিত্যিককেই এই পথে পা রাখতে দেখা গেছে, কিন্তু ফজলুল হক যুগ ও সময়ের নিরিখে কীভাবে এই সমাজের বিবর্তন ঘটে চলেছে তার মননশীল পর্যালোচনা করেছেন। সেদিক থেকেও তাঁর গভীর নিরীক্ষা ঐতিহাসিক এবং বিজ্ঞানীর ভূমিকা পালন করেছে। একদিকে ধর্মাদর্শ এবং অপরদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস দুইই এই সম্প্রদায়ের মেরুদন্ড ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে । সেই স্থলে শিক্ষা, যুক্তি ও মননের প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা তিনি স্পষ্ট করেছেন। লেখার সাবলীলতা, সংকেতময়তা এবং কাব্যিক প্রয়োগ সবেতেই তাঁকে ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই সৃষ্টিক্ষেত্রে তিনি বিরাজ করলেও তাঁর অনুচ্চ স্বর কেউ শুনতে পায়নি, সম্মান তো দূরের কথা। সুতরাং তাঁর কথা আজ বলতেই হল।
বাংলা কথাসাহিত্যে বীরভূমের রাঙামাটি কতখানি ঊর্বর তা সম্পূর্ণরূপে জানতে হলে লেখক এই ফজলুল হককে পড়তেই হবে। ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন বিতর্কিত, তেমনি সাহিত্যজীবনেও বিতর্কের অবকাশ এনে দিয়েছেন। সমাজের প্রচলিত আচারসর্বস্ব ধর্মকে তিনি তোয়াক্কা করেননি। বরং ধর্মকে মানবিক কল্যাণের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি সমাজ থেকে নির্বাসিত। আবার হৃদয়ের টানে রীনা কবিরাজকে সঙ্গিনী করে দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেছেন। সেদিক থেকেও তাঁকে সমাজশাসনের রুদ্রমূর্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। সাহিত্যই তাঁর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতেই এবং সামাজিক অবক্ষয় ও মানবিকতার সমূহ অন্তরায়কে এর মাধ্যমেই তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। একটা সুগঠিত মানবসমাজের প্রবক্তা হিসেবেই তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রচৈতন্যের জাগরণ নিয়ে আসতে চান। তাই প্রতিটি উপন্যাস ও গল্পের মধ্যে মননধর্মিতার সঙ্গে মানবসত্যের চিরন্তন আবেদনকে বৈপ্লবিক অনুজ্ঞায় পর্যবেসিত করেছেন। তাই তাঁর রচনায় আদিম প্রবৃত্তির প্রকাশ যেমন ঘটেছে, তেমনি দ্বান্দ্বিক ক্ষতবিক্ষত বিবেক দংশনেরও পরিচয় আছে। অস্কার ওয়াইল্ডের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন : “Everything in the world is about sex except sex, Sex is about power.”
ফজলুল হক (জন্ম ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ইলামবাজার থানার নৃপতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম হাজি মহম্মদ ইসা মোল্লা, মায়ের নাম তসলিমা বিবি।স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু। এতে তিনি এতই আসক্ত হয়ে পড়েন যে পড়াশুনো অসমাপ্ত রেখেই লেখালেখি নিয়ে সময় কাটাতে থাকেন। ১৩৮০ বঙ্গাব্দে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত “প্রবাসী” পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় লিখে ফেলেন একটি ছোটগল্প “বিপ্রলব্ধ”। সেই থেকেই পথহাঁটা শুরু। ১৯৭৮ তে “তমসুক” নামে একটি পত্রিকাও রীনা কবিরাজসহ সম্পাদনা করেন। ১৯৮৬ পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে চলে পত্রিকাটি। ২০০২ থেকে প্রকাশিত হয় “কবিতা এবং কবিতা” নামে ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি। “চণ্ডীদাস”কে বিশেষ মাসিক সংখ্যা হিসেবেও সম্পাদনা করতে থাকেন ২০১০ থেকে।
ফজলুল হক মূলত গল্প লিখতেই বেশি ভালবাসেন। তবে নাজিম আফরোজ ছদ্মনামে বেশ কিছু কবিতাও লিখেছেন। ইতিমধ্যে কবিতাগুলি “জাদুকথা” কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প ও উপন্যাসগুলির নাম হল : “এক চিলতে খোলা আকাশ”,“ জাদুবাক্স”, “নিসর্গের রূপকথা”, “ছায়াবৈরী”, “গন্ধমূষিক”, “সাদারুমাল”, “বিলাপের জান্নাত”, “কারিকুরি”, “শিকড়ের টান”, “যোগফল শূন্য”, “মিথ্যুক”, “গোরের গোলাম”, “গন্ধ”, “চারপাশে ঘন অন্ধকার”, “আঁকা থাকে দুটি ঠোঁট”, “নাই বা মনে রাখলে”, “নিজের ভিতর সে নিজে”, “টাওয়ার”, “ভিতরের ছবি”, “মিস্টার বুড়ি এ্যান্ড মিসেস বুড়ো”, “নীল দহন”, “ব্যারণের লাভা”, “চ্যারেট ডট্ কম্” ইত্যাদি । আরও অজস্র গল্প বহু পত্র পত্রিকার ছড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে “রচনা সংগ্রহ”ও প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি রচনাতেই ব্যক্তিহৃদয়ের দহন, সময়, রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। কোথাও রূপকের আশ্রয়ে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিয়েছেন। কোথাও বা পীড়ন ও শোষণ বঞ্চনার ছবি। “জাদুবাক্স” উপন্যাসটিতে জাদুবাক্স বলা হয়েছে আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বিস্ময়কর অবদান কম্পিউটারকেই। মানুষের মনন জগতেও এই কম্পিউটার কীভাবে আলোড়ন তুলেছে এবং একজন অশীতিপর বৃদ্ধের জীবনেও, তারই সূক্ষ্ম বিন্যাসে এক মানবিক জাগরণের কাহিনি। সেখানে ধর্মভিরু এক বৃদ্ধ হাজি সাহেবের কম্পিউটার শিক্ষার সাথে পরিচয় একটা নতুন বিশ্বের সূচনা করেছে। তার দ্বারা কোরান অনূদিত হয়ে কম্পিউটারে কম্পোজ করা হয়েছে। তেমনি এই বৃদ্ধের নাতনি ডাক্তারি পড়তে গিয়ে এক ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে বাঁধা পড়েছে। তাদের হাতেই নতুন কম্পিউটারের উদ্বোধন। বেশ ইংগিতপূর্ণ একটি মেসেজ তিনি সমাজকে দিতে চেয়েছেন।
“নিসর্গের রূপকথা”তেও প্রেমের দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন, শোকবিহ্বল অবস্থাতেও কীরকম কামের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, সেই বাস্তব কাহিনির সঙ্গে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের মননচেতনা খুবই নিখুঁত ভাবে বর্ণনা করেছেন।প্রেমের থেকে শরীরই বেশি অগ্রসর হতে পারে লেখকের এই প্রতীতি ঘটেছে। তবে সেইসব ঝোপড়াবাসী তুচ্ছ মানুষের অন্তরেও বিবেকের জ্যোতি এখনও টিম টিম করে জ্বলছে, লেখক তা আশ্চর্য কৌশলে দেখিয়ে দিয়েছেন। গরিব মানুষ, গৃহহারা হলেও মানবিকশূন্য নয়।
সমাজে ভণ্ডামি, ধর্মের নামে গোঁড়ামি এসবকেই আক্রমণ করেছেন প্রতিটি ছোটগল্পে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবিকতার জয় ঘোষণা এইসব গল্পের মর্মমূলে বিরাজ করেছে। “ছায়াবৈরী” একটু ভিন্নধারার উপন্যাস। দুজন নায়কের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই। প্রথম যৌবনে সুন্দরী নাদিরাকে না পাওয়ার বেদনা ভুলতে পারেনি ইসমাইল। এর প্রতিশোধ নিতে প্রেমিক দিলখুশের সঙ্গে তার বিয়েও হতে দেয়নি। কিন্তু সময়ের কাছে সেও পরাজিত। নাদিরা তার বিবাহিত জীবনে সুখ পায়নি। বিধবা হয়ে এসে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। এদিকে দিলখুশও স্ত্রী বিয়োগের পর বহু ভাঙন অতিক্রম করে তার কাছাকাছি এসেছে। আবার ইসমাইলের সন্দেহের শিকার সে। কিন্তু তা যে ঠিক নয় তা বুঝতে পেরেছে আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিলখুশের বিয়ে করার পর। তখন সমাজ বিচ্যুত দিলখুশকে অন্যভাবে শাস্তি দিতে চেয়েছে। সেটাও সম্ভব হয়নি। এমনকী তার মৃত্যুর পর দেহদান করার কারণে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে গেছে ইসমাইলের। লেখক মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এক নির্বাক আততির পর্যায়ে পাঠককে নিয়ে যেতে পেরেছেন। ইসমাইল নিজেই নিজের বৈরী হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত।চেতনা প্রবাহ আত্মচারী মগ্নতায় বেশ জটিল মনে হতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ব্যক্তি অস্মিতার টানাপোড়েন কতখানি বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে মথিত তা বোঝা যায়। দেশ কাল পাত্র এই উপন্যাসটিতে একটা আবহ তৈরি করে দেয়, যা লেখকের ব্যক্তিজীবনের রৌদ্রছায়ার সংকল হয়ে উঠেছে।
“জাদুকথা”র কবিতাগুলিতে এক অসাধারণ আলো পড়েছে, যাতে লেখক আত্মউৎসের পথে বারবার হেঁটেছেন আত্মমগ্ন যাত্রায়। নিজের মধ্যেই অনন্ত রূপের বিস্ময় আর প্রবৃত্তির জাগরণকেই জাদুকথা বলেছেন। এই জাদু আদি-উৎসের মধ্যেই নিহিত। সেইখান থেকেই সংবাদ আসে কবির অনুভূতিলোকে, স্নায়ুর কোষে কোষে। তাই কবিকে বলতে শুনি “চিঠি আসে, চিঠি আসে….” । এই চিঠি আসার শেষ নেই। এ চিঠি অনন্ত চিঠি। অন্য একটি কবিতায় গহনচারী শূন্যতার দিশারি কবিকে এই নিজস্ব পথই খুঁজতে দেখি :
“অজস্র নারী বুকভরা ভালোবাসা দিতে ব্যর্থ
নিরালা আদিম রাত্রির অন্ধকারে ঘুমহীন চোখে
সোনাঝুরির সবুজ ঘাস ছেড়ে অনেক দূরে
সামাজিক জটিল কঠিন যুবতী
শরীরের যাবতীয় সম্পদ ভরে
অন্ধকার খোঁজে হলুদ শাড়ির ভিতর
বুকের উপর মুখ রেখে মুখের উপর আরো কিছু
অন্যকিছু অনেককিছু প্রকৃতি তা জানে না।”
এই “অনেককিছুর” মধ্যেই জীবনের প্রত্যয়, জীবনের রসদ, জীবনের মানে থাকে। শুধু শরীর নয়, শুধু কাম নয়, শুধু বিরহ নয়, শূন্যতার নিরিখে আছে অনন্ত পিপাসাও। আমরা জানি Life can be good, if we decide that it is.
জীবনের প্রান্ত সীমানায় পৌঁছেও ফজলুল হকের কলম থামেনি। সম্প্রতি “ছায়ানিলয়” নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস একটা লিটিল ম্যাগাজিনে (একমাত্র) লিখতে শুরু করেছেন। প্রথম অংশেই উপন্যাসটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মূল্যবোধ হারানো মুসলিম সমাজের কাছে মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার কাহিনি। আগামী প্রজন্মের কাছে এই উপন্যাসটিতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলবে।