বাঙালি মুসলমান বলতেই যখন শিক্ষিত ‘এলিটরা’ চোখে সর্ষে ফুল দেখে


মঙ্গলবার,২৪/০৭/২০১৮
965

একরামূল হক শেখ---

” আর একটি দিকের কথা উল্লেখ করতেই হয়, না হলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকার সম্ভাবনা থাকে। সেটা হল পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের নিয়ে লেখালেখি হলেও সেগুলি কোন বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। ‘দলিত’ সাহিত্য এখন জাতে উঠলেও পশ্চিমবঙ্গের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে লেখা কটা বই পাঠ্য আছে তা আমার জানা নেই। ‘বাঙালি মুসলমান’ বলতেই যখন শিক্ষিত ‘এলিটরা’ চোখে সর্ষে ফুল দেখে, সেখানে এদের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রচিত বই সিলেবাসে থাকবে, এটা এক ধরণের ‘খোয়াব’ ছাড়া আর কি বা হতে পারে।” ( পৃষ্ঠা ১৪)

” আমি আমার নাম অন্তত নূ্ন্যতম তিনবার না বললে আজপর্যন্ত কোথাও কেউ বুঝতে পারেনি। অমল, বিমল, তরুণ, তাপস তারপর আবু সিদ্দিক। নাম শুনে, নাম লেখক আমার দিকে কি রকম বোকা বোকা চেয়ে থাকেন।তারপর তাঁর কলম ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। পরে লেখেন ঠিকই, কিন্তু আবু সিদ্দিক নয়, কেউ লেখেন আব্দুস সিদ্দিক, কেউ লেখেন আবুল সাদিক, কেউ আবার আবদুল সিধধিক এবং আরও কত কি। আমি প্রথম প্রথম ওনাদেরকে আমার নামের বানান ঠিক করতে অনুরোধ করতাম। এখন আর করি না। আমি এখন আমার নামের চিরকুটটি বুক পকেটে না জিন্সের পেছন পকেটে না মানি ব্যাগে রাখব চিন্তা করি। ( পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬)

” বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকুরী, পরিবহণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে তাদের বেহাল দশা নানা কৌশলে চেপে রেখে এদের শিরদাঁড়া ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এটি মুসলমানদের বুঝতে হবে। তাদের আসল পরিচয় গোপন করে তারা যেন মাথা তুলতে না পারে সেজন্য তাদেরকে জানা-অজানা বাছা বাছা অসম্মানজনক বিশেষণে ভূষিত করা হয়। আর মজার ব্যাপার বর্ণিত
বেশিরভাগ বিশেষণগুলি বাঙালি মুসলমানের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে শুধু বেমানানই নয় দৃষ্টিকটুও বটে। একথা আমি জোর দিয়ে বারংবার বলতে পারি। আসলে যেসব দোষে বাঙালি মুসলমানদের দোষী করা হয়, সেগুলি নির্লজ্জভাবে নির্ভেজাল মিথ্যা। এটি একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত, এবং এর পিছনে পশ্চিমবঙ্গের ‘পঙ্কিল’ রাজনীতির সাথে সাথে তথাকথিত বাঙালি বুদ্ধিজীবির ‘নেকসাস’-এর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।” ( পৃষ্ঠা ৪৬-৪৭)

”একদিকে মুসলমানদের শুধুমাত্র ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে তুলে ধরা যেমন মুসলমানদের উপকার না করে ক্ষতি করে। তেমনি ভুরি ভুরি মুসলমান বিদ্বেষী দগদগে বিষোদাগারে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, লালিত, পালিত ও সমাদৃত। আর এই বিষ পান করা বাঙালি মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে সহজ হয় না। সাহিত্য পড়ে আমরা নূতন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পাই। কিন্তু বাংলা সাহিত্য পড়ে বাঙালি মুসলমানের হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। এ সাহিত্য না তাদের জীবনকে প্রতিফলিত করে, না তাদেরকে বাঁচতে শেখায়।” ( পৃষ্ঠা ৪৭ )

” আমার দেখা মুসলমান অধ্যুষিত এলাকার মোড়ল, মাতব্বর, পঞ্চায়েত লেভেলের নেতা, ছোট ব্যবসায়ী ঘরের ছেলেমেয়েরা সাধারণত মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ করে না। যারা করে তারা নেহাতই গরীব দিন আনা দিন খাওয়া মুসলমান ঘরের। আরা যারা চাকরি বাকরি বা অন্য কাজে প্রতিষ্ঠিত তারা ছেলেমেয়েদের মিশনে বা ইংলিশ মিডিয়মে পড়ায়। আল্লা, রসূলকে মানলেও মাদ্রাসার ধার মাড়ায় না। কারণ যুগের দাবি ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।”(পৃষ্ঠা ৬২)

” মুসলমানের নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বেশ পারদর্শী। ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে চোখ রাখলে, অথবা টিভি খুললে একটা না একটা খবর মুসলমান তথা বাঙালি মুসলমানের থাকবেই।
এবং ওই খবরের বিষয়–মুসলমানের গরু পাচার, মাদক পাচার, বোমা বাঁধা, পাকিস্তানের গুপ্তচর, আই এস আই-এর এজেন্ট, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, পকেটমার, সাইকেল চোর, বৌ বা মেয়ে নিয়ে পালানো, এবং আরও অনেক কিছু যা কিছুটা সত্য আর বাকিটা লাগামহীন কাল্পনিক কু-কাজের কেচ্ছা। খবরগুলি মিথ্যা নয়, একথা যতটা সত্য, ঠিক একইভাবে এটাও সত্য নয় যে বাঙালি মুসলমানের জন্ম কেবলমাত্র খারাপ কাজ করার জন্যই।” ( পৃষ্ঠা ৯৪)

” সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কুরান কথায় কথায় জিহাদ বা পবিত্র ধর্মযুদ্ধের অনুমতি দেয় না। কুরানের বার্তা হল মুখ্যত শান্তি ও সহিষ্ণুতা। রাস্তায় অমুসলিমদের দেখা হলেই অ্যাটাক করতে হবে বা অমুসলিমদের সঙ্গে সুখে শান্তিতে মুসলিমদের পাশাপাশি বাস করা যাবে না, ইত্যাদির ন্যায় উগ্র ও মনুষ্য ধর্মের পরিপন্থী কথা-বার্তার প্রশ্রয় কুরানে নেই। কুরানের ভুল ব্যাখ্যা করে বলা হচ্ছে যে এই ধর্মগ্রন্থই যত ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী। কুরান ধর্মযুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছে একমাত্র আত্মরক্ষার কথা ভেবে। মুসলমানদের যদি কেউ ভিটে মাটি ছাড়া করতে বাধ্য করে বা মুসলমানরা যদি এক্সট্রিম পারসিকিউশনের কবলে পড়ে, সে ক্ষেত্রে কুরান মুসলমানদের হাত গুটিয়ে বসে থাকতে বলে নি। আত্মরক্ষার জন্য তাদেরকে হয় জিহাদ নয় হিজরার পথ অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছে। জিহাদের সারমর্ম এটিই। এর সাথে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের কোন সম্পর্ক নেই।” (পৃষ্ঠা ২১৭)

মাস খানেক আগে এক পিএইচ ডি গবেষকের কাছে এই বই ( বাংলার মুসলমান) দেখি এবং একটু নাড়াচাড়া করেই তাকেই বলি বইটি সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য। সাধারণত যা করি না, সেদিন থেকেই পড়া শুরু করি এবং আমার মতো মন্থর পাঠকও তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি এ বই। লেখক মুর্শিদাবাদ জেলার ভূমিপুত্র হওয়ার সুবাদে মুসলমান সমাজকে খুবই নিবিড়ভাবেই দেখেছেন। শুধু দেখেন নি গভীরভাবে উপলব্ধিও করেছেন এবং আমার ধারণা তিনি সেটিকে দীর্ঘদিন পোটলা বেঁধে বয়ে বেড়িয়েছেন। তথ্য কণ্টকিত না করেও একেবারে মাটি ঘেঁষা সাহসী বিশ্লেষণ করেছেন আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটা কলেজে ইংরেজির শিক্ষক আবু সিদ্দিক মহাশয়।

ব্যক্তিমতে আমার দৃষ্টিতে মুসলমান সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কিত এটা সেরা চতুর্থ গ্রন্থ। প্রথম এম এন রায়ের ‘ ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান’, দ্বিতীয় সুরজিৎ দাশগুপ্তের ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ , তৃতীয় সুমিতা দাশের ‘অন্য এক রেনেসাঁস: আরবি-ইসলামীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ’ এবং চতুর্থ ‘বাংলার মুসলমান’। আপানরা কি বলেন, কিন্তু বলার আগে পড়তে হবে… তাই না…।

[ আবু সিদ্দিক, বাংলার মুসলমান, সোপান, ২০৬ বিধান সরণি, কলকাতা-৭০০ ০০৬, প্রথম প্রকাশ ২০১৮। ফোন ০৩৩-২২৫৭৩৭৩৮/ ৯৪৩৩৩৪৩৬১৬, মূল্য ৩০০ টাকা ]

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট