কাঁসাই, যার পোশাকি নাম কংসাবতি, তার কোলেই আমাদের বাস। এখনও। প্রথম প্রথম ওই নদী পেরিয়ে নিয়মিত স্কুল যাওয়া শুরু হল ক্লাস ফাইভে।প্রতাপপুর হাইস্কুল। সে সময় থেকেই খবরের কাগজের সঙ্গে সখ্যতা আমার। যদিও আব্বা বাইরে গেলে বাড়িতে দৈনিক আনতেন মাঝে মধ্যে। ওই সময় কি পড়তাম বা দেখতাম তা আজ আর মনে নেই।তবে, এটা মনে আছে তিন প্রধান মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহামেডান-এর লীগ ফুটবলের খেলার খবর রাখতাম প্রতিদিনই। নদী পেরিয়ে যেখানে পত্রিকা পড়া প্রথম শুরু করি, সেটি ইউনুস চাচার চা-দোকান। তাঁর এক পায়ে একটু সমস্যা থাকায় লোকমুখে তাঁর নাম হয় খোঁড়া ইউনুস। প্রথম যেদিন খবরের কাগজ পড়তে দোকানে প্রবেশ করি, বুক দুরু দুরু করছিল। যদি কিছু বলে। এ-থেকে পরিত্রাণের জন্য একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেলি। গরম চা খেতে গিয়ে জিভ পুড়ে সে এক নয়া বিপত্তি। বাড়িতে আমাদের সেসময় চায়ের অভ্যাস ছিল না। চলত সরবত।
সেই যে শুরু, আজ তক সে প্রেমে একবিন্দুও ভাটা পড়ে নি। এর একটা বড় কারণ ইংরেজ সম্প্রদায়। তখন প্রাইমারিতেও ছিল ইংরেজি । তাই গেঁয়ো হয়েও একটু আধটু ইংরেজি শিখেছিলাম। প্রায় এক দশক রাজ্যের বাইরে থাকাকালে ইংরেজি দৈনিকই ভরসা ছিল আমার। যদিও দু-একদিনের বাসি আনন্দবাজারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম সুরাটে, বরোদায়। এরই মাঝে একসময় প্রায় ৬ মাসের জন্য রাজস্থানের পালি জেলার জাইতারান মহকুমার রাবড়িয়াবাস গ্রামে ডিএলএফ ( বর্তমানে নাম আম্বুজা ) সিমেন্ট কারখানায় কাজ করেছিলাম। সেখান থেকে কাছাকাছি শহর বেওাবার-এর দুরত্ব ছিল ১১৩ কিমি। আমরা যখন সেখানে গিয়েছি, সেখানে শুধুই ছিল পাথর ও পাহাড়। ওখানে আমার পেপার পড়ার কথা কাকে বলি, কে শুনবে এ-প্রেম কাহিনী। অগত্যা এক ছুটির দিন শহরে গিয়ে এক দোকান ঠিক করে এলাম, যেখানে প্রতিদিনের Hindustan Times জমা থাকবে। আমাদের কোম্পানির গাড়ি শহরে গেলে একসাথে সবগুলো আমার কাছে হাজির হত। রাতে যখন আমি ওই বাসি পেপার পড়তাম, আমার সহকর্মী রমেশ মেশরাম ( মহারাষ্ট্র), রাধাকান্ত পানি ( উড়িষ্যা ) প্রমুখরা শুধুই বলতো ‘পুরানা পেপার পড়কর ক্যায়া ফায়দা।’। আমি তাদের উত্তর না দিয়েই শুধু হেসে বলতাম, আচ্ছা লাগতা হ্যায়।কিন্তু ওরা কী জানে আমি তো কেবলই সম্পাদকীয় ও উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধেই মজে থাকতাম। খবরে একটু আধটু চোখ বুলাতাম।
ভারতের প্রায় সব ইংরেজি কাগজ আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বহুদিন করে পড়েছি। আমার পরিচিত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব্রা যারা বিদেশে কর্মসূত্রে আছেন বা ছিলেন। তারা যখন আমার জন্য কী আনবে জানতে চাইতো, আমি বলতাম পত্রপত্রিকা। এক বন্ধু কাতার থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আমানা প্রকাশনের ইংরেজি অনুবাদ কুরআন উপহার দেয়।ইংরেজি ভাষায় বিশ্বে যেটি সর্বাধিক প্রচারিত, তার অনুবাদক হলেন আবদুল্লা ইউসুফ আলি ( ১৪ এপ্রিল ১৮৭২-১০ ডিসেম্বর ১৯৫৩)। জন্মস্থান বোম্বাই শহর। আরেকজন অনুজ দীর্ঘদিন ছিল দুবাইয়ে। তাঁর কাছে পেলাম, Gulf News, Khaleej Times, Los Angeles Times Middle East সংস্করণ প্রভৃতি।আমার এক আত্মীয়র মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত The Straits Times পেয়ে আমিতো অবাক। সঠিক মনে নেই প্রায় ৯০ পৃষ্ঠার দৈনিক। একটা কাগজ পড়তেই, হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে। এই কাগজের উত্তর সম্পাদকীয়তে দ্য স্টেটসম্যানের দীর্ঘ দিনের সম্পাদক সুনন্দ কে দত্ত-রায়-এর লেখা দেখে ভালই লেগেছিল। আমার আব্বা শিক্ষক মানুষ। একবার ঢাকার টুঙ্গি ইজতেমায় গিয়েছিলেন। আমি কিছুই বলিনি, ফেরার সময় প্রথম আলো, ইত্তেফাক-সহ ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে প্রায় ১০/১২ টি দৈনিক নিয়ে উপস্থিত। নেটে ওগুলো দেখি, কিন্তু একটু নরম করে হাতের স্পর্শের অনুভুতিই আলাদা। এখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি, সকালবেলাই দিল্লী, চেন্নাই-য়ের কাগজ কলকাতায় হাজিরা দিলেও, আমরা কেন ঢাকার প্রথম আলো, ইত্তেফাক এখানে এবং বাংলাদেশের বাঙালি আনন্দবাজার, এই সময় পড়তে পাবে না। এ এক হেঁয়ালিও বটে। উভয় দেশের ভুক্তভোগীরা সচেতন হলেই সমাধান সম্ভব হবেই।
হঠাৎই মনের দরজায় এসব ভিড় করতে লাগলো আজ। সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে একটি ইংরেজি দৈনিক কিনলাম। দাম কত হতে পারে বলুনতো ? ৫ টাকা নাহলে ৬/৭ টাকা তাই না । কিন্তু আমাদের এই কলকাতা শহর থেকেই প্রকাশিত এই দৈনিকটির জন্য হকার চাইল ১৯ টাকা। বহুদিন এই পত্রিকা পড়েছি কলকাতাতেই। কিন্তু ভাবতে পারিনি অন্যদের সঙ্গে দামে এতো ফারাক।কিন্তু কামেও কম যায় না এটি। যে কোনও মানদণ্ডেই ভারতের সেরা ইংরজি সংবাদপত্রের নাম The Hindu। দেশের শ্রেষ্ঠ সেকুলার দৈনিকও। যারা খবরের কাগজের মাধ্যমে বুদ্ধিগত চর্চা করতে আগ্রহী, খরচ একা বহন না করতে পারলেও, গ্রুপ করেই নিয়মিত পড়ুন এই ইংরেজি দৈনিক। আপনাদের ভিন্নমতে অংশী হতে আগ্রহী।