অনশনের এগারদিন অতিক্রান্ত। কর্তৃপক্ষের কোন হেলদোল নেই। কাল মেডিকেল কলেজে স্রোতের মত মানুষ এসেছেন। রাজনীতির পাশা খেলায় যারা পরস্পরের বিরুদ্ধে দান দেন, তারা সবাই এসেছেন নতমস্তকে। শুধু আসেন নি যার আসার কথা ছিল- অনশনের রথ চেপে যার অভিষেক। কথায় কথায় রাজা-উজির মারা নেতাদের ও দেখা যায় নি আশেপাশে।
মেডিকেল কলেজের এই সব দামাল ছাত্রছাত্রীরা যে অসামান্য দৃঢ়তায় লড়াই করছে তা অভূতপূর্ব। চারিদিকে যখন ক্ষুদ্র, লক্ষ্যহীন ঘৃণার রাজনীতির কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ, তখন আত্মসংযমের যে নজির তারা সৃষ্টি করেছে তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সম্পর্কে যে নেতিবাচক মনোভাব সাধারণ্যে প্রচলিত নবীন যুবকদের এই নৈতিক উচ্চমান তার বিরুদ্ধে মূর্তিমান প্রতিবাদ। আমরা জানি চিকিৎসকদের বেশিরভাগই কল্যাণের শপথ নিয়েছে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সোসাল মিডিয়া আর পেশাদার রাজনীতিকদের কল্যাণে যে ঘৃণার স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল, এই ছেলেমেয়েদের কাজে তা অনেকটাই স্তিমিত।
মেডিকেল কলেজ শুধু চিকিৎসক তৈরী করে না, এর চৌহদ্দি জুড়ে মানবতার যে স্রোত, তা আমাদের বৃহত্তর সামাজিক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। যে চেতনার রঙে চিকিৎসক মানবিক হয়ে ওঠে। এই যুবকদের দেখে আশার সঞ্চার হচ্ছে ভবিষ্যত বোধহয় এত নিরাশাজনক নয়।
অনিকেতদের জয় হোক।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের জয় হোক।
ডা: আদিত্য সরকার গুরুচন্ডালী তে লিখেছেন
অনিকেত কে? কি তার পরিচয়? কোন উত্তরাধিকার কে সে বহন করে??
আমরা এখন অনেকেই জানি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গত ১১ দিনেরর বেশি দিন ধরে ৬ জন ডাক্তারি ছাত্র অনশনরত। নব নির্মিত একটি ১১ তলার হোস্টেলে স্বচ্ছ কাউন্সেলিং করে, যাতে সমস্ত উপযুক্ত ছাত্রছাত্রী সেই হোস্টেলে থাকার অধিকার পায়, সেই দাবিতে।
ভেবে দেখুন।
১. অনিকেত, অর্ণব, দেবাশিষ, হিল্লোল, সুমন, অয়ন এর কেউ নিজের জন্যে অনশন করছে না।
২. এরা বলছে না কিছু নির্দিষ্ট ছাত্রছাত্রী কেই হোস্টেল দেওয়া হোক, যারা এদের ঘনিষ্ঠ।
৩. এরা কেউ বলছে না, ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের সরিয়ে দিয়ে ওদের হোস্টেল দেওয়া হোক।
৪. ওরা এতদিন যেমন মেডিকেল কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র মিলে মিশে থেকেছে, পরীক্ষার আগের রাত থেকে, শরীর খারাপের গোটা দিন, ব্রেক-আপের মন খারাপ থেকে, কলেজ ফেস্টের উৎসবে, সেটাই চাইছে যাতে অবিরত থাকুক।
৫. ওরা কেউ নতুন হোস্টেল ভাংচুর করছেনা, কেউ সেখানে জবর-দখল করছে না, কেউ প্রিন্সিপ্যাল কে চেয়ার বা জলের বোতল ছুঁড়ে মারছে না।
এবার মেডিকেল কলেজ ছাড়িয়ে এসে, ছাত্র আন্দোলন ছাড়িয়ে এসে, অনশন ছাড়িয়ে এসে একটা অন্যকথা ভাবুন।
আপনার কথা ভাবুন। আপনার স্বাস্থের কথা ভাবুন।
স্বাস্থের অধিকার আর স্বাস্থ্য আন্দোলনের কথা ভাবুন। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল কর্পোরেট হাসপাতাল আর তার স্বাস্থ্য ব্যবসার কথা ভাবুন।
সরকারি হাসপাতলের যোগ্য চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মী থাকা স্বত্বেও তার অব্যবস্থার কথা ভাবুন।
এই মুহুর্তে আমাদের দেশ তথা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা এক চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বলছে জিডিপির ন্যুনতম ৫% স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ্য করতে, সারা পৃথিবীর গড় যেখানে ৬%, প্রথম বিশ্বের দেশগুলো যেখানে ১০-২০% ব্যয় করছে, সেখানে আমাদের দেশে ১.০২% ব্যয় করছে সরকার।
বছরের পর বছর সরকারি হাসপাতালের অবহেলা আর তাল মিলিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের শোষণ- এই দুই যাঁতাকলের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য একটা বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে।
এই অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায়, নানান সময়ে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভে ফেটে পড়া ছাড়া আর উপায় থাকছেনা।
গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিকী প্রতিনিধি হিসেবে বারবার তাই ডাক্তাররা জনরোষের মুখে পড়ছেন। অথচ এই জনবিমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত রোগটা বিক্ষিপ্ত কয়েকজন ডাক্তারের ‘সাধারণ মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার’ বা উন্নাসিক আচরণের থেকে অনেক, অনেক গভীরে।
সচেতন, সংবেদনশীল এবং ওয়াকিবহাল নাগরিকরা এগিয়ে আসছেন এই রোগের প্রকৃত কারণটা খুঁজতে।
ঠিক এইখানে আমি একটু থামতে বলছি। ভেবে দেখতে বলছি, মনে করতে বলছি সেই সমস্ত ডাক্তারদের কথা, স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা, যারা বিষয়টাকে নিজেদের পেশাগত জায়গার বাইরে এসে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উল্টোদিকে থাকা সাধারণ মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
ব্যবস্থাটার ভিতরে থেকে তারাই চিনিয়ে দিচ্ছেন এর মধ্যেকার দূর্নীতি, এর অসারতা, এর শুষ্ক কাঠামো থেকে ঝড়ে পরা ঘুণ।
শুধু তাই নয়, পাশাপাশি তারা দেখাচ্ছেন সম্ভাব্য সমাধানের পথ। তারা আহ্বান জানাচ্ছেন একটা বৃহৎ স্বাস্থ্য আন্দোলনে যোগদান করার। জনমুখী একটা কল্যাণকর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার। “সবার জন্যে স্বাস্থ্যের”।
অনিকেত এই চিকিৎসকদের সন্তান। অয়ন, সুমন, হিল্লোল এই চিকিৎসকদের উত্তরাধিকার। সুযোগ্য উত্তরাধিকার।
অনিকেতরা সেই ডাক্তারিছাত্রদের প্রতিনিধি যারা ১৯৮০-র দশকে স্বাস্থ্য আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন সরকারি হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা এক্স-রে, ই সি জি ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা চালু করার জন্যে। অয়নরা সেই ডাক্তারিছাত্রদের উত্তরসূরি যারা নব্বই এর দশকে কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে গেছেন, বস্তিবাসী মানুষদের স্বাস্থ্যের হাল হকিকতের খোঁজ তাঁদের মধ্যে গিয়ে নিয়ে এসেছেন।
আর তাই শুধু বর্তমান নয়, যে কোন শাসক দলের কাছেই এই উত্তরাধিকার একটা বড় দু:স্বপ্ন। আসন্ন স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি।
এইটা মেনে নিতে চাইছেনা রাষ্ট্র। এইটা মানতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ। তাই চাইছে একদম ফার্স্ট ইয়ার থেকে, একদম ‘তৃনমূল’ স্তর থেকে এই সম্ভাবনা সমূলে বিনাশ করতে।
অনিকেতদের এই আন্দোলন এই মূহুর্তে তাই এতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এতখানি সময়োচিত, এতখানি জরুরি।
এই উত্তরাধিকার কে টিকিয়ে আমাদের রাখতেই হবে। আমাদের জন্যে, আমাদের স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্যে, আমাদের ভবিষ্যৎ এর জন্যে। এ’ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই।
অনিকেত শব্দের অর্থ -যার ঘর নেই। অনিকেতদের এই ঘর চাওয়ার দাবি মিলেমিশে যাক আমাদের সবার বিজ্ঞান সম্মত স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবির সাথে। অনিকেতদের এই আন্দোলন মিলেমিশে যাক আমাদের “সবার জন্যে স্বাস্থ্যের” আন্দোলনের সাথে।
অনিকেতদের জয় হোক।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের জয় হোক।
মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল উচ্ছল ভদ্রের অসুস্থতা নিয়ে যে খবরটি “এই সময়” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তা ঘরে বসে বানানো ও সর্বৈব মিথ্যা। উচ্ছলদা অসুস্থ বোধ করতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে পুন্যব্রত গুণদা নিজে দাঁডিয়ে থেকে তাঁর হাসপাতালে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। কয়েকজন ছাত্র কার্ডিওলজিতে গিয়ে তাঁর খোঁজখবর নিয়ে আসে। তখন ইসিজি করা হয়েছে ও তাঁর শারীরিক অবস্থাও স্টেবল ছিল। খবর পড়ে এরকম ভুল ধারনা হতে পারে যে তাঁর চিকিৎসায় বাধা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি পিজিতে চলে গিয়েছেন। যে যুবকরা দশদিন না খেয়ে লড়ে যাচ্ছে তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন, যেমন উচ্ছলদার অসুস্থতা নিয়েও উদ্বিগ্ন। একটা ছোট্ট গুনগত পার্থক্য আছে- ছাত্ররা তাদের স্যরের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর মিনিটে মিনিটে নিয়েছে, তাদের স্যার “আপনি বাঁচলে বাপের নাম” করে পলায়ন করেছেন। আমরা সবাই চাই তিনি সুস্থ হোন, স্বাভাবিক হোন ও নিজের কাজে যোগ দিন।
উচ্ছলদার অসুস্থতা নিয়ে “এই সময়” পত্রিকায় যে দুজন বিবৃতি দিয়েছেন তাঁদের একজনের সঙ্গে আজ ঘটনাচক্রে দেখা হল। ঘটনার কথা তুলতেই তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। আমরা অনশন মঞ্চে বসে ছিলাম- তিনি ছিলেন না, অথচ কিভাবে এত সব খবর পেলেন জানার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, তিনি যেভাবে দ্রুত স্থানত্যাগ করলেন,তাঁর সুসংবাদদাতা সঞ্জয়ের আর খোঁজ পেলাম না।
ফেসবুকে দেখছি কেউ কেউ ছাত্রদের আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে বলছেন। কেউ মনে করতে পারেন যে, ছাত্ররা নতুন হস্টেলে জায়গা দখল করে প্রথমবর্ষের সুকুমারমতি বালকবালিকাদের মস্তক ধোলাই করতে চাইছে।সে সুযোগ না পেয়ে তারা “অনশন আন্দোলন” করছে বলে মনে করলে কিন্তু ভুল করবেন। আসলে কর্তৃপক্ষের বহুমুখী অপদার্থতায় ছাত্ররা হতাশ- ছাত্রদের কাউন্সিলিং না করিয়ে কর্তৃপক্ষ অন্যায় করেছে, একতরফা ভাবে একটি ১১তলা বিল্ডিং একটি বিশেষ বর্ষের জন্য ঘোষনা করে অন্যায় করেছে, সেই এগার তলা বাড়ীতে স্নাতকোত্তর শ্রেনীর ছাত্রদের জোর করে ঢুকিয়ে অন্যায় করেছে, একজন সদ্য পাশকরা অযোগ্য ব্যক্তিকে সুপার ঘোষনা করে ভুল করেছে ও সেই বিল্ডিংয়ে গেস্ট হাউস বানানোর পরিকল্পনা করে অন্যায় করেছে। কর্তৃপক্ষের অসহিষ্ণু ও অনমনীয় মনোভাবে ছাত্রছাত্রীদের আত্মসম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে। অনশন শুরু করার আগে প্রায় দশদিন তারা প্রতিবাদ ধর্না চালিয়েছে। কিন্তু বিনা প্ররোচনায় পুলিশ তাদের উপর লাঠি চালিয়েছে। ছাত্ররা কি অনশন ছাড়া অন্য কিছু করতে পারতো? কচিকাঁচারা কবে আর পরিনাম ভেবে কাজ করেছে- তারা আমাদের ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তোলার জন্য অপরিনামদর্শীতা দেখিয়েছে। আমরা পরিনামদর্শী-তাই মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ; তাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয়ে কেঁপে উঠি। তাই, ফাঁকা ব্যালট দেওয়ার ফরমান পেয়ে মেরুদণ্ড আর বিবেকের লড়াইয়ে বিনিদ্র রাত কাটাই, তারপর সটান আত্মসমর্পন করি। ভুলে যাই, নেকড়ে ও পোশাক পাল্টে গর্দভ চর্মাবৃত হয়ে আসতে পারে-খুর আর থাবা দেখে তাকে চিনতে হয়। নিরীহ মেসেজ হিসেবে যা আসে তা হল আত্মসমর্পনের ফরমান, নিজেকে নি:শেষে বিলিয়ে দেওয়ার গব্বরী হুঙ্কার।
মেডিকেলের এই দুরন্ত, দামাল অপরিনামদর্শী ছেলেরা যদি আমাদের চেনা পথের পথিক না হয় তবে তাদের দোষ দিতে পারি না। তারা যদি শাসকের চোখে চোখ রেখে অসমান্য ঋজুতায় শঠতা আর শয়তানীর মুখোশ খুলতে চায় তাদের দোষ দিতে পারি না। তারা যদি মেডিকেল কলেজের ক্ষুদ্র গণ্ডী ছাড়িয়ে সমাজের দিনবদলের স্বপ্ন দেখতে চায়, তাদের দোষ দিতে চাই না। আমরা পারি নি, তাই তাদের ও পারতে দেব না, নিজের বিবেককে চোখ ঠেরে, সব অন্যায়কে হাস্যমুখে হজম করে, চন্দনপালঙ্কে সুখে নিদ্রা যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করার প্রচেষ্টাকে মহৎ বলে প্রশংসা করতে পারছি না।
বর্তমান অবস্থার দায় প্রশাসনের। ছাত্রদের সব দাবী মেনে নিয়ে দ্রুত তাদের ক্লাসরুমে ফেরত পাঠানোর দায় কর্তৃপক্ষের। যারা কর্তৃপক্ষের হয়ে নিরাপদ দুরত্বে দাঁডিয়ে অদৃশ্য পুতুল খেলা খেলছেন তাদেরও প্রকাশ্যে এসে নিজের দায় স্বীকার করা উচিত। ছাত্রছাত্রীদের জীবন কোন অবস্থাতেই দর কষাকষির বিষয় হতে পারে না। কিন্তু তাদের আবেগকে মর্যাদা দিয়েই গ্রহনযোগ্য সমাধানের রাস্তা বার করতে হবে। সে ব্যবস্থা যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল।