বই প্রকাশের জন্য কখনও কোনও প্রকাশকের দরজায় যাইনি। কখনও কোনও বড়ো কবির সঙ্গে দেখাও করিনি। বাংলার একটি প্রান্তিক জেলা বীরভূমের ততোধিক প্রান্তিক গ্রামে থাকি। নানা ঘাতপ্রতিঘাতে বড়ো হওয়া। নামকরা কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। হোমরাচোমরা কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়াও মাথার উপর নেমে আসেনি। সর্বত্রই একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গের শিকার হয়েছি সারাজীবন। বহু চেষ্টায় একটা চাকুরি পেতেও বহু বেগ পেতে হয়েছে। আজ অবধি যে কয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে তা ভালবাসার দানই বলতে হবে। কেউই খুব নামী প্রকাশক নন। তবু ভালবেসে ডেকেছেন আমাকে। পাণ্ডুলিপি চেয়েছেন, বইও করেছেন।
কিছু লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিরদিনই আমাকে দূরে রাখতে চান। কিছু কবিও আমাকে সহ্য করতে পারেন না। অবশ্য এসবের কোনও কারণও আমি খুঁজে পাইনি। তবে কিছু কবি ও সম্পাদকের এতই ভালবাসা জীবনে পেয়েছি যে কোনওদিনই তা ভুলতে পারব না। তাঁদের কথা মনে পড়লে কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে যায়।
আজও একডাকে কলকাতার কোনও অনুষ্ঠানে আসতে ভয় পাই। নিজেকে ঠিক মেলে ধরতে পারি না। মাটি মাখা আর ঘামভেজা নুন বেরোনো শরীরকে এখনও মার্জিত করে তুলতে শিখিনি। এক আলুথালু জীর্ণতায় আড়ষ্ট হয়ে থাকি। হয়তো গ্রাম্যতা আর চিরন্তন এক দীনতা আমাকে গ্রাস করে থাকে।
‘দেশ`পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হওয়া দেখে অনেকেই আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন। কবিতা লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন। আজ তাঁরা আমার থেকে অনেক বড়ো কবি। তাঁদের দেখি আর খুব ভালো লাগে। ভাঙা ইঁট জড়ো করা আমার পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে আমি একা একা তাঁদের কথা ভাবি। রোদ পড়ে এলে দেখি, সজনে গাছে শুঁয়োপোকারা চলাফেরা করে। আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। কখনও পাখিদের সঙ্গেও।
কোনওদিন কবিতা লেখা হলে নিজেকে নিজেই একটা পুরস্কার দিই। কখনও একটা চকোলেট, কখনও একটা নতুন কলম। আর নিজেকে উৎসাহ দিই নিজেই হাততালি দিয়ে। বউ উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে কখনও বলে বসে “এত পাগলামি আর ভাল্লাগে না!”
এবছর “জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা,” “উন্মাদ বিকেলের জংশন” এবং “স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি” এর মতো বইগুলিও প্রকাশকেরা যে ভালবাসায় প্রকাশ করলেন এবং আমাকে সম্মানিত করলেন তা তুলনাহীন। আমি ধন্য হয়েছি, কারণ আমার মতো গেঁয়ো তুচ্ছকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করা যে লাভজনক ব্যবসা নয় তা সবাই জানে। পাঠকই বিচারক। বইগুলি যদি সত্যিই ভালো লেগে থাকে তো আমার আনন্দ।
নিজের কথা
রবিবার,২২/০৭/২০১৮
829
তৈমুর খান---