অশোক মজুমদার

শহীদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ, শহীদ তোমায় ভুলিনি মোরা, ‘শহীদ স্মরণে আপন মরণে রক্ত ঋণ শোধ করো’ এসব কথা স্লোগান, গান, দেওয়াল, ক্যাম্পাসে আমরা ছোটবেলা থেকে দেখছি, শুনছি। তবুও শহর, গ্রামের আনাচে কানাচে ভাঙা ও বিষ্ঠা লাঞ্ছিত অযত্নে মলিন শহীদ বেদীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় এই কথাগুলির প্রকৃত অর্থ আমরা বুঝতে পারিনি। শহীদরা তাই শুধু আটকে থাকেন আমাদের স্মৃতি, ইতিহাস, বেদী আর আবক্ষ মূর্তিতেই। তাদের স্বপ্ন ও কাজ কখনোই আমাদের কাজের দর্শন ও প্রেরণা হয়ে উঠতে পারেনা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রম। শহীদদের স্বপ্ন ও ইচ্ছেগুলিকে তিনি রূপ দিয়ে চলেছেন তার লাগাতার কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। ২১শে জুলাই তার কাছে এই স্বপ্ন ও ইচ্ছেপূরণের এক উদযাপন। প্রতি বছর এই দিনটিতে তিনি দেখে নেন অত্যাচারী সিপিএমকে তাড়িয়ে নতুন বাংলা গড়ে তোলার শপথ বুকে নিয়ে যে বন্ধন, বিশ্বনাথ, মুরারি, রতন, কল্যাণ, অসীম, কেশব, শ্রীকান্ত, দিলীপ, রঞ্জিত, প্রদীপ, খালেক, ইনুরা শহীদ হলেন তা তিনি কতটা বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন।

১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই আমার জীবনেরও এক স্মরণীয় দিন। ১৯৮৬ সাল থেকে দিদির ছবি তুলছি। কিন্তু সেদিন তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘আজ আর ছবি তুলতে হবেনা’। সে কথায় পরে আসছি। নিজের সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি কোন বড় ঘটনা বা ঘোষণায় নয়, একজন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বকে আসলে চেনা যায় লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটা ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে। অনেকেই হয়তো জানেন না, প্রতি বছরই দিদির শহীদ দিবসের সকালটা শুরু হয় তার কালীঘাটের বাড়িতে আসা ২১শে জুলাইয়ের ১৩জন শহীদদের পরিবারের লোকেদের সঙ্গে দেখা করার মধ্যে দিয়ে। তিনি সেদিন তাদের সবার সঙ্গে দেখা করেন, কথা বলেন, তারা কেমন আছেন খোঁজখবর নেন, সমস্যা থাকলে তা সমাধানের নির্দেশ দেন। সবকিছু মেটার পর তাদের খাইয়ে দাইয়ে বাড়ি কিংবা সমাবেশে পাঠিয়ে নিজে শহীদ দিবসের মঞ্চের দিকে রওনা দেন। এ বছর ২১শে জুলাইয়ের ২৫ বছর পূর্তি। এবারও এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হবে না। এর মধ্যে দিয়েই কোন ঘোষণা বা শ্লোগান ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তৃণমূল কংগ্রেস একটা যৌথ পরিবার আর দিদি সেই পরিবারের এক স্নেহময়ী অভিভাবিকা। এই মানবিক সম্পর্কই তৃণমূলের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও চালিকা শক্তি।

২৫ বছর আগের ২১শে জুলাই দিনটা আমি কোনদিন ভুলব না। তখন আমি আনন্দবাজারে। সচিত্র পরিচয়পত্র সহ ভোট গ্রহণের দাবিতে ধর্মতলায় তৃণমূলের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সমাবেশ। ছবি তুলতে সেখানে পৌছতে দেখি নানা দিক থেকে মানুষের স্রোত আছড়ে পড়ছে সেখানে। আমরা সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিকরা ছড়িয়ে ছিলাম ধর্মতলা, মহাকরণ, লালবাজার, মেয়ো রোড সহ বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে। আমার সঙ্গে ছিলেন আনন্দবাজারের সাংবাদিক অনিন্দ্য জানা। আমি ছিলাম মেয়ো রোডে। খবর ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও থাকবেন সেখানে। আস্তে আস্তে মিছিল আসা শুরু হল, বাড়তে লাগলো ভিড়। শুরু থেকেই একটা অস্বাভাবিক ঘটনা লক্ষ্য করছিলাম আমি। দেখছিলাম সেদিন লাঠিধারী পুলিশের তুলনায় বন্দুকধারী পুলিশের সংখ্যা বেশি। শান্তিপূর্ণ সমাবেশে এত বন্দুকধারী কেন সে প্রশ্ন মনে উঁকি দিয়ে গেল। দেখছিলাম পুলিশের ব্যবহার খুবই কর্কশ, তারা কোথাও আমাদের দাঁড়াতেই দিচ্ছিল না। পুলিশের শাসানি, জনস্রোত, একের পর এক আসা মিছিলে আমরা তখন দিশেহারা।

হঠাৎই দেখলাম ভিড় সরানোর নামে পুলিশ আচমকা লাঠি চার্জ শুরু করে দিল। একের পর এক ফাটতে লাগলো টিয়ার গ্যাসের শেল। আমাদের দিকেও তেড়ে এল পুলিশ, পিঠে পড়তে লাগলো লাঠি। মারমুখী পুলিশ তখন কারও কথা শুনছে না। আমি দৌড়তে শুরু করলাম প্রেস ক্লাবের দিকে। একটু গিয়েই পড়ে গেলাম। দূরে তাকিয়ে দেখি অনিন্দ্যকেও বেধড়ক লাঠিপেটা করছে পুলিশ। মানুষ, সাংবাদিক, তৃণমূল কর্মী সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই মারছে। একজন পুলিশ আমার চুলের মুঠি ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকাতে থাকলো। একটু পরেই তার সঙ্গে যোগ দিল আরও একজন। চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানোর পাশাপাশি গায়ে পড়তে লাগলো বুটের লাথি। ওরা আমাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলতে চাইছিল। কোনমতে তাদের থেকে নিস্তার পেয়ে দৌড় দিলাম ধর্মতলার দিকে।

দৌড়তে দৌড়তেই শুনলাম, দিদি চলে গেছেন মহাকরণের সামনে। পুলিশ তাকে সেখানে ব্যপক মারধোর করছে। আমিও ছুটলাম সেদিকে, কারণ আমি তখনও এই বিক্ষোভের নেত্রীর একটি ছবিও তুলতে পারিনি। মেট্রোর বাঁদিক দিয়ে ক্যামেরা লুকিয়ে ছুটছি, হঠাৎ শুনি গুলির আওয়াজ। পিছনে তাকিয়ে দেখি পুলিশ হাঁটু গেড়ে বসে পজিশন নিয়ে ধর্মতলার দিকে জড়ো হওয়া মানুষের দিকে তাক করে গুলি চালাচ্ছে। আমার পাশ দিয়ে কিছু পুলিশ দুটো মানুষকে টেনে নিয়ে গেল। এবার সত্যি ঘাবড়ে গেলাম। আমাদের তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখলাম একটা থামের আড়ালে দাড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পজিশন নিয়েছেন। নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছিল। আমার সামনে ছবি তোলার মত কোন আড়াল নেই। পিছনের দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম রাইটার্সের দিকে। রাইটার্সের সামনে গিয়ে দেখি ট্র্যাফিক কিয়স্কের ওপর দিদি মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। যন্ত্রণা কাতর মুখ, বিধ্বস্ত অবস্থা, ডান হাতের কনুইটা অনেকটা ফুলে উঠেছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সৌগত রায়, সোনালি ও আরও অন্যান্যরা।

দিদি কথা বলতে পারছিলেন না। আমায় দেখেই বলে উঠলেন, ‘তোরা সব ঠিক আছিস তো? আজ আর ছবি তুলতে হবে না’। আমি গুলিতে অনেকের মারা যাবার কথা বলতে যেতেই পিছন থেকে একজন আমার মুখ চেপে ধরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। কারণ, ওই অবস্থাতেই কর্মী ও সমর্থকরা কেমন আছে তা জানতে দিদি ধর্মতলা চত্বরের অন্য জায়গায় চলে যেতে চাইছিলেন। কোন মতে তাকে নিরস্ত্র করা গিয়েছে। আমার কাছ থেকে গুলি চালানোর কথা শুনলে তাকে আর আটকানো যেত না। তিনি যে কোন ভাবেই বন্দুক বাগানো পুলিশের সামনে চলে যেতেন। সেদিনের ঘটনার বিবরণ এই স্বল্প পরিসরে শেষ করা যাবে না। এটা তার উপযুক্ত জায়গাও নয়।

আমার সেদিন প্রথম থেকেই মনে হয়েছে গোটা ঘটনাটাই পূর্ব পরিকল্পিত। দায়িত্ব নিয়ে বলছি সেদিন পুলিশের টার্গেট ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভিড়ের ভিতর তাকে দেখতে পায়নি বলেই দিদি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেছেন। যারা বলেন মহাকরণ দখল আটকাতেই পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাদের বলি এজন্য ধর্মতলায় গুলি চালাতে হবে কেন? সেখানে পুলিশ তো গ্যাস ও লাঠি দিয়েই জনতাকে সরিয়ে দিতে পারতো। পুলিশের ওপর কোন আক্রমণের ঘটনা সেখানে ঘটেনি, পুলিশই প্রথম মারধোর শুরু করে। মহাকরণের সামনে পুলিশের দিদিকে ফেলে পেটানোর ছবিও সেদিন কোন চিত্রসাংবাদিক তুলতে পারেন নি। কারণ, তার আগেই তাদের ঘটনাস্থল থেকে মেরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেদিনের বিক্ষোভ সমাবেশ কভার করতে আসা সব চিত্রসাংবাদিকই পুলিশের মারে আহত হয়েছিলেন।

কেন সেদিন গুলি চলেছিল, কেই বা এর নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। এর মধ্যেই বদলে গেছে রাজনীতির রঙ। সেসময় বিপক্ষে থাকা অনেক নেতা, প্রশাসক, আধিকারিকরা এখন দিদির কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। গণতন্ত্রের এটা ট্র্যাজেডি না কমেডি তা আমি বলতে পারবো না। তবে যতদিন বেঁচে থাকবো এই শহীদ স্মরণ দিবসের ছবি তুলে যাবো আমি।

শহীদ হওয়া মানুষদের স্বপ্ন ও স্মৃতিকে জীবন্ত করে তোলার এমন উদ্যোগ আর কোন রাজনৈতিক দল নেয় বলে আমি জানি না। সময় বদলেছে, বদলেছে রাজনীতি। শুধু বদলাননি দিদি। এত নৃশংসতা ও লাগাতার আক্রমণেও তার মানবিক দিকগুলো একটুও টাল খায় নি। প্রতিবছর ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে দিদিকে উঠতে দেখে আমার প্রথমেই মনে হয় শহীদদের মনে রাখার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে এই তার মঞ্চে ওঠার সময় হল। ভাবি, সমাবেশের মঞ্চে আগেভাগে চলে আসা তো আমার মত সাধারণ লোকদের জন্য। শহীদদের পরিবারের লোকদের সঙ্গে দেখা করার মধ্যে দিয়ে তার শহীদ স্মরন তো অনেক আগেই হয়ে গেছে। শহীদদের পরিবারের লোকেদের মধ্যে দিয়েই দিদি যেন স্পর্শ করেন শহীদদের। নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে রাজ্য ও জাতীয় ক্ষেত্রে দলের রাজনীতির নতুন দিশা তুলে ধরেন তিনি। যা মাথায় রেখে পথ চলেন দলের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীরা।

Satwajit Mondal

Share
Published by
Satwajit Mondal

Recent Posts

স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী

আজ, ১২ জানুয়ারি ২০২৫, আমরা উদযাপন করছি স্বামী বিবেকানন্দের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনটি কেবল তাঁর…

2 months ago

কবি এ কে সরকার শাওনের প্রথম উপন্যাস “অতল জলে জলাঞ্জলি” প্রকাশিত।

১০ জানুয়ারি ২০২৫ এর বই মেলা উপলক্ষে বাজারে এসেছে কবি এ কে সরকার শাওনের প্রথম…

2 months ago

উত্তরবঙ্গের আবহাওয়া আপডেট

আগামী ৪৮ ঘণ্টায় উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল ও সিকিমের আবহাওয়া রইবে বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল। পার্বত্য অঞ্চল ও…

2 months ago

সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের উপর কড়া নির্দেশ জারি

রাজ্যের সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে কর্মরত চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে কড়া নির্দেশিকা জারি করল…

2 months ago

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ আজ, অপেক্ষা ভোটের দিন ঘোষণার

জাতীয় নির্বাচন কমিশন আজ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশ করবে। দুপুর ২টায় এক সাংবাদিক সম্মেলনের…

2 months ago

নেপাল-তিব্বত সীমান্তে তীব্র ভূমিকম্পে ৫৩ জনের মৃত্যু, আহত ৬২ জন

নেপাল-তিব্বত সীমান্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পে এখনও পর্যন্ত ৫৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং আরও ৬২…

2 months ago