দিদির সঙ্গে ঘুরছি, সেই ১৯৮৬ সাল থেকে। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি যে দিদির সব মনে থাকে! কার বাড়িতে অসুখ বিসুখ, কার ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করেছে, কার জন্মদিন বা কার কোন প্রিয়জন মারা গেছেন সব তিনি খবর রাখেন। এবং তার খবর রাখা মানে কিছু না কিছু করা, কোন না কোন ব্যাবস্থা নেওয়া। দলীয় কর্মী ও নেতা থেকে শুরু করে পাড়ার প্রবীণ মানুষ, প্রশাসক থেকে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী থেকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রের ব্যাক্তিত্ব সবাই যে তার নেটওয়ার্কে আছেন তা তারা নিজেরাও জানেন না। তার পরিচিত সব মানুষদেরই তিনি তাদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। এই খোঁজখবর রাখার মধ্যে দিয়েই প্রবল ব্যস্ততা ও কঠোর অনুশাসনের মধ্যে তার মানবিক মুখটা বারবার উঁকি দিয়ে যায়। আজ সকালে একটা ছোট্ট ঘটনায় তার প্রমাণ পেলাম।
শিলিগুড়ির উত্তরকন্যায় আলিপুরদুয়ারের প্রশাসনিক বৈঠক। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও রয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব ও প্রশাসনের নানা স্তরের শীর্ষ কর্তা এবং আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসক। বৈঠকে খোদ দিদি রয়েছেন তাই সবাই খুব তটস্থ। কখন কাকে কী জিজ্ঞাসা করেন বা কাজটা কেন হয়নি বলে কৈফিয়ত তলব করেন তা ভেবে সবাই বেশ চাপে রয়েছেন। এখানে একটা কথা বলা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না, জেলা স্তরের প্রশাসনকে সচল ও সজীব রাখতে দিদি মন্ত্রী, মুখ্যসচিব, সংশ্লিষ্ট আমলা, জেলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজ্য প্রশাসন সবাইকে জেলায় নিয়ে গিয়ে এই বৈঠকের যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা একশো ভাগ সফল। খোলামেলা মত বিনিময়, সমালোচনা, সংশোধনের মধ্যে দিয়ে জেলা প্রশাসন যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
বৈঠকের শুরুতেই দিদি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনাদের সবার কাছ থেকে দু মিনিট সময় চেয়ে নিচ্ছি। আজ আলিপুরদুয়ারের জেলাশাসক নিখিল নির্মলের জন্মদিন। ওর জন্য আমি একটা কেক এনেছি। এই বলে তিনি কেকটা কেটে জেলাশাসককে খাইয়ে দিলেন। গম্ভীর প্রশাসনিক বৈঠক এক মুহূর্তে মানবিক হয়ে উঠলো। দিদি বললেন, সরকারি কাজ আছে, থাকবেও। তার মধ্যেই আসবে নানা বিশেষ দিন। আজ তেমনই একটা বিশেষ দিন। এই দিনগুলিকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। আমি মনে করি আমরা সবাই মিলে একটা পরিবার। এই দিনগুলি পালনের মধ্যে দিয়ে আমাদের নিজেদের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করতে হবে। শুধু আজকে নয়, এই কাজটা দিদিকে আমি বহুবার করতে দেখেছি। কীভাবে এত ব্যস্ততার মধ্যে এতসব খোঁজখবর রাখেন, প্রস্তুতি নেন তা ভেবে আমি অবাক হই।
আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে অন্যের ব্যাক্তিগত মুহূর্ত ও দিনগুলিকে এভাবে মনে রাখা ও সন্মান দেওয়াটা আমি আর কোন রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখিনি। সাধারণ কর্মী থেকে প্রশাসক সবার জন্মদিন পালনে তাদের এত উৎসাহ থাকে না। দল ও প্রশাসনে কাজ, শৃঙ্খলা, পুরস্কার, তিরস্কার সবই থাকবে কিন্তু কোন মূল্যে মানবিক মূল্যবোধকে যে বাদ দেওয়া যাবে না তা আজ সকালে দিদির কাছ থেকে আবার আমি নতুন করে শিখলাম। আগামীকাল সকালে রাজ্যের দৈনিক পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলগুলি এই জন্মদিন পালন নিয়ে কিছু লিখবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় এই ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে দিয়ে দিদির রাজনীতির একটা মানবিক মুখ ফুটে ওঠে যা অন্যান্য রাজনীতিবিদদের থেকে তাকে আলাদা করে দিয়েছে। দিদি মনে করেন, দলীয় এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যারা কাজ করেন তেমন সব মানুষই তার বৃহত্তর পরিবারের অংশ। তাদের সুখে তিনি সুখী হন, তারা দুঃখ পেলে তিনিও গভীর দুঃখ অনুভব করেন। এই আত্মীয়তাবোধই তাকে তাদের জন্মদিন পালনে উৎসাহী করে তোলে।
অশোক মজুমদার