আনন্দবাজারে প্রায় তিন বছর হল কাজে ঢুকেছি, এটা নব্বইএর দশকের গোড়ার দিকের ঘটনা


শুক্রবার,২৯/০৬/২০১৮
940

অশোক মজুমদার---

আনন্দবাজারে প্রায় তিন বছর হল কাজে ঢুকেছি। এটা নব্বইএর দশকের গোড়ার দিকের ঘটনা। একদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি টেলিগ্রাফের চিফ ফটোগ্রাফার অলকদা একটা ছবি নিয়ে যা ইচ্ছা বলে যাচ্ছেন। ঘরে অনেকের সঙ্গে রয়েছেন, তারাপদ ব্যানার্জি, তপন দাস, দেবীপ্রসাদ সিংহ সহ কিছু সহকর্মীরা। আমাকে দেখেই অলকদার চিৎকার এই যে দাড়ি (আমায় দাড়ি খোকা নামে ডাকতেন) তোমার বন্ধু কীসব ছবি তুলছে! যা ইচ্ছা তুললেই কি ছবি হয়? টেবিলে রাখা স্টেটসম্যান কাগজের ছবিটাতে দেখলাম – একটা ট্রাম যাচ্ছে, রাস্তায় একটা ছোট ছেলে পিচকিরিটা পেছনে লুকিয়ে দুহাত দিয়ে ধরে রেখেছে। ছবিটা দেখেই মনে হচ্ছে জানলায় বসা লোকেদের পিচকিরি দিয়ে রঙ দেবে। দোলের আগের দিন প্রকাশিত এই ছবিটিতে দোলের আগমন বার্তা ও শিশুর নির্দোষ দুষ্টুমি একসঙ্গে মিশে একটা চমৎকার মুহূর্ত রচনা করেছে। দেখার চোখ ও টাইমিং নিখুঁত না হলে এ ছবি তোলা যায় না।

আমি প্রথমেই বললাম, অলকদা ছবিটায় কোন মেরিট না থাকলে আমরা আলোচনা করছি কেন? আর স্টেটসম্যান ছবিটা ছাপলোই বা কেন? এ নিয়ে আমাদের ভেতর একটু তর্কাতর্কি হল। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, অলকদা বলে কথা! কাজেই বেশিরভাগ সহকর্মীই অলকদার সঙ্গে সহমত হলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না শুধু স্টেটসম্যান-এ ফোন করে ফটোগ্রাফারকে অভিনন্দন জানালাম।

এই ছবিটা সৌমিত্র ঘোষের তোলা। একটু আলাপ ছিল, মোটসোটা চেহারা, ছোটকরে ছাঁটা চুল। মাঝে মাঝে দেখা হত। খুব মার্জিত, মুখে সবসময় হাসি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তার এই ছবিটাই আমার মনে গেঁথে ছিল। আমার থেকে দু বছরের ছোট ছিল সৌমিত্র, কিডনির অসুখে মারা গেল। মারা যাবার পাঁচ দিন আগেও ডায়ালিসিসের পর সৌমিত্র বলল, অশোক সাহেব একদিন বাড়ি এস। তোমার ছবিগুলো নিয়ে এবার কিছু একটা করতেই হবে। ছবি ও কাজের জন্য আমি ওকে বরাবর শ্রদ্ধা করতাম। ইন্ডিপেনডেন্ট, স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়া টুডে, ডি এন এ, হিন্দুস্তান টাইমস এসব নামী কাগজের ফটোগ্রাফি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছে সৌমিত্র। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি তিনটি ভাষাতেই সমান দক্ষ। বলা ও লেখা সবেতেই সমান পটু। এর পাশাপাশি কবিতা,গজল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, হিন্দি গান সবকিছুতেই সৌমিত্র আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুদের মধ্যে সবার উপরে।

সৌমিত্রর নাকতলার বাড়ির দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। বহু ছেলে ওর বাড়িতে দিনের পর দিন থেকে খেয়ে এখন দেশের নানা কাগজে মাথা উঁচু করে কাজ করছে। কলকাতার বহু ফটোগ্রাফারকে ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি দিয়েছে। নাকতলার বাড়িটা ছিল আমাদের কাছে একটা বিরাট আকর্ষণ। আনন্দ, হৈহুল্লোড়, আড্ডা সবকিছুর জন্যই আমাদের সৌমিত্রর বাড়ির কথা সবথেকে আগে মনে পড়ত। নানা বিষয়ে তার ভাবনার তীক্ষ্ণতা আমাকে বারবার অবাক করেছে। এককথায় আমি ছিলাম ওর গুণমুগ্ধ। ছবি তোলার কাজে নানা জায়গায় সফরে সৌমিত্র বহুবার আমার সঙ্গী হয়েছে। আমিই বলতাম ওকে যাওয়ার কথা। কারণ, সৌমিত্রর বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে অনেককিছু শিখিয়েছে। ও আমার কাজের প্রশংসা করলে আমার লজ্জাই করত। আনন্দবাজারে কাজ করার একটা সুবিধা আছে। কাজের গুণে তেমন বড় না হলেও সবাই বড় ঠাউরে নেয়। সরকার বাড়িতে কোনভাবে ঢুকে পড়া লোকজন এর সুযোগ নেয়।

দেখা হলেই সৌমিত্রর সেই একটাই কথা, আমার ভাল ছবিগুলোকে নিয়ে একটা বই আর একটা একজিবিশন। আলাপের শুরু থেকেই ও মাঝে মাঝেই একটা কথা সমানে বলতো, একটা রোলের দোকান দেব। যা লাভ হবে, তা নিয়ে একটা ফিল্ম করবো। আমি হাসতাম, ও কিন্তু সেই দোকান করেই ছাড়লো। জেনে রাখুন মুম্বাই, কলকাতাসহ আরও বহু শহরে ও হ্যাংলা নামে একটা ফুড চেন তৈরি করলো। সারারাত সে দোকান খোলা থাকতো। আমির খান, রানি মুখার্জি সহ বলিউডের বহু সেলিব্রেটি ছিল ওর নিয়মিত কাস্টমার। দিল্লি, কলকাতা এমন কি দুবাইতেও হ্যাংলার শাখা ছিল। কলকাতার আউটলেটগুলোতে কাজ করতো প্রায় ৪২ জন কর্মী। সেসময় ওর ধ্যান-জ্ঞ্যান-প্রাণ সবই হ্যাংলা। এতসমস্ত কিছু করার পর শেষদিকে সৌমিত্র হয়ে গেল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব ও মূলায়ম সিং যাদবের আলোকচিত্রী। পরোপকারী সৌমিত্র সেখানেও কলকাতার দুজন ফটোগ্রাফারকে কাজ দিয়েছে। পার্থ ও শান্তনু এখনও সেখানে কাজ করছে।

পাটনায় নিতীশ কুমারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দিদির সঙ্গে আমিও হাজির। ওদিক থেকে মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশের সঙ্গে এসেছে সৌমিত্র। চা পানের বিরতিতে অখিলেশ দিদিকে বলেন, ‘দিদি, দিদি, আপকো বাঙ্গাল সে এক আদমি কো ভাগাকে লে আয়া’। দিদি ঠিক বুঝতে পারে না। অখিলেশও হাসছে। সৌমিত্রকে দেখিয়ে আমি দিদিকে বলি, এ সৌমিত্র, আমার বন্ধু, কলকাতার ছেলে। এখন অখিলেশের ফটোগ্রাফার। দিদি হেসে ওঠে, খুব মজাও পায়। সৌমিত্র আমাকে অখিলেশের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। অখিলেশের সঙ্গে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়। লখনৌতে ওর অফিসে গেলেই অখিলেশ একটা বড় গ্লাস ভর্তি দুধ খেতে দেয়। ঐ গ্লাস দেখে আমার ভয় লাগে।

সৌমিত্রর কথা যেন আর শেষ হতে চায় না। ওর সবচেয়ে ভাল দিক ছিল ছবি নিয়ে নিত্যনতুন ভাবনা। এই ডিজিটাল ক্যামেরার যুগেও আমার কলকাতার আলোকচিত্রী ভাই ও বন্ধুদের অনেকেই ছবি নিয়ে পুরোনো ভাবনার বাইরে বেরোতে পারলো না। তারা শুধু ময়দান- ধর্মতলা- গঙ্গার ঘাটেই আটকে রইলো। ফিল্ম ক্যামেরা নিয়ে অমিত, দিলীপ, ভাস্কর, তপন দা, তারা দা, অলক দা, সুব্রত দা কত ভালো ভালো কাজ করে গেছে আর আমরা কিছুই পারলাম না। বছরের পর বছর এক ছবি দেখে মানুষ ক্লান্ত। অথচ কলকাতার আলোকচিত্রীদের একসময় সারাদেশের আলোকচিত্রীরা সমীহ করতো। এখনও দেশবিদেশের বহু খবরের কাগজ ও এজেন্সিগুলিতে কলকাতা থেকে যাওয়া আলোকচিত্রীদের কত সুনাম! কিন্তু নিজভূমেই আমরা সেই মর্যাদার আসনটা হারাতে চলেছি।

যাদুগোড়া ইউরেনিয়াম মাইনস এলাকায় সৌমিত্র আমার একটা ছবি তুলেছিল। এটা আমার খুব প্রিয় ছবি। তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণের জন্য স্থানীয় মানুষরা বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল। এ নিয়ে তখন খুব হৈচৈ। এই ঘটনা কভার করতে গিয়েছি। সারাদিন ঘুরে খুব ক্লান্ত, ক্ষিদেও পেয়েছে। এক আদিবাসী গ্রামে জল খেয়ে সৌমিত্রকে কিছু খাবার জোগাড় করতে পাঠাই। অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে আমি একটা খাটিয়াতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি নিজেই জানি না। সৌমিত্রর ডাকে ঘুম ভেঙে দেখি ওর হাতে পাউরুটি, ডিম আর কলা। সেসব খেয়ে কাজকর্ম শেষ করে দুদিন পর কলকাতায় ফিরলাম। কিছুদিন পর ও আমাকে একটা সাদা কালো ছবির প্রিন্ট দেয়। সেই ছবি দেখে আমি তো অবাক। দেখি আমি শুয়ে আছি, আর আমার চারপাশে ভিড় করে আছে আদিবাসী শিশুরা। আমি বুঝতেই পারিনি। সৌমিত্রকে আমার কাছে আসতে দেখে শিশুরা সরে যায়। অনেক কথা মনে পড়ছে। সবচাইতে বেশি মনে পড়ে তোর সেই কথাটা “অশোক সাহেব সারা জীবন শুধু ভাল ভাল ছবি তুলেই গেলে এবার ছবিগুলো নিয়ে কিছু একটা কর”। একথাটা সৌমিত্র ছাড়া আমাকে আর কেউ বলতো না। আমাকে একথাটা বলার আর কেউ রইলো না। আজ সৌমিত্রর জন্মদিন। চোখের জলে আমার নৌকা টলমল করে ওঠে।
লেখাটি অশোক মজুমদার-এর ফেসবুক ওয়াল থেকে তুলে দেওয়া হল পাঠাক দরবারে।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট