চাকরির ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু বঞ্চনার ইতিহাস সুবিদিত। অভিযোগে প্রকাশ পূর্বে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ক্ষেত্রে চরম বঞ্চনার শিকার হয়েছে সংখ্যালঘুরা। সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরেকেটে ৫-৬ জন শিক্ষক-অশিক্ষক চাকুরীজীবি মুসলিম স্থায়ি ও অস্থায়ি পদে কর্মরত আছেন।
ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বাংলার সংখ্যালঘুদের ব্যাপক বঞ্চনা, শোচনীয় অনুন্নয়ন ও তজ্জনিত সঙ্কটের কথা রাজ্য রাজনীতিতে অতিপরিচিত আলোচ্য বিষয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে এই মাত্রা অতি শোচনীয়। এ রাজ্যের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দশা মারাত্বক রূপ ধারণ করেছে। ছয় দশকের প্রাচীন এই কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৩-৪ জন সংখ্যালঘু শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হয়েছেন। অশিক্ষক কর্মীও মেরেকেটে জনা-দুয়েক হবে। বর্তমানে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫৯/১৬৩ জন শিক্ষক শিক্ষকতা করছেন। পত্র-পত্রিকাকে দেওয়ার সূত্রে এই সংখ্যা ১৮০ জন। এই অনুপাতে সংখ্যালঘু শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪-৫ জন শুধু কমই নয়, সংখ্যালঘুরা ব্যাপক বঞ্চনার শিকার এই পরিসংখ্যানেই বলে দেয়।
সরকারের নীতি-নির্ধারণ বা পলিসি মেকিং ও গৃহীত নীতি রূপায়ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে যথাযথ নিয়ম মেনে ফলপ্রসূ করার দাবি এবং অদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকারকে জনসার্থে সুনিশ্চিত করার জোরালো দাবি উঠছে।
২০১৪ সালে যে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল তা দীর্ঘ চার বছর বন্ধ থাকার পর হঠাৎই নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা না করে তড়িঘড়ি শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। নিয়োগ যখন হবেই তাহলে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিয়ে নয় কেন? উঠছে প্রশ্ন।
বর্তমান নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০ পয়েণ্ট রোস্টার রক্ষিত হচ্ছে না বলে বিভিন্ন জনের অভিযোগ। ইউজিসি শিক্ষক নিয়োগে নতুন বিধি চালু করেছে। অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্স ইনডেক্স-এ পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষক নিয়োগে নতুন বিধিতে এপিআই-কে মান্যতা দেওয়া হয়। এই হিসেবে ২০১৪ সালে যারা আবেদন করেছিলেন তাদের এই চার বছরে এপিআই-র যথেষ্ট পরিবর্তন স্বাভাবিক। আবার এই সময়ে অনেকেই নতুন করে নেট, সেট, পিএইচডি ইত্যাদি বিষয়ে শংষাপত্র পেয়েছেন। তারা এই আবেদন থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন। নতুনদের জন্যে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে নিয়োগ নিয়ে শুরু হয়েছে চরম জটিলতা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমোদিত শিক্ষকের সংখ্যা ৩০২ জন। সূত্রে জানা গেছে বতর্মানে শিক্ষক সংখ্যা ১৬২ জন। উপাচার্যের দাবি ১৮০। এখনও অনেক শূন্যপদ পূরণ হয়নি। এর মধ্য থেকে হাতেগুনে মাত্র ১০ বিভাগ থেকে শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে এখানেও বাকী বিভাগ কেন নয় ? বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ শিক্ষকের দাবী, এই বিভাগগুলিতে আছেন বিভিন্ন আধিকারিক, স্থানীয় বিধায়ক ও উপাচার্যের স্নেহভাজন অধ্যাপকদের পরিচিত ও আত্মীয়স্বজন। তাদের সুযোগ করে দিতেই এই আয়োজন। কম্পিউটার সায়েন্স ও বাংলা বিভাগে স্বজনপোষনের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই। কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে স্থানীয় বিধায়কের ছেলে প্রার্থী।
সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১০০ পয়েণ্ট রোস্টার রক্ষিত হয়নি। বেশ কয়েকটি বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভাগের রোস্টারে বন্টিত সহযোগী ও অধ্যাপক পদ সংরক্ষিত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে এ অভিযোগও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। সরকারের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও, ২০১৪ সালের বিজ্ঞাপিত নিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর হঠাৎই চার বছর পর এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। হিমঘরে চলে যাওয়া এই প্রক্রিয়াকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে কেন নিয়োগ করা হচ্ছে না সে প্রশ্নও উঠছে।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ক্ষেত্রে চরম বঞ্চনার শিকার হয়েছে সংখ্যালঘুরা। সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ কামরুজ্জামানের দাবি, আপটুডেট ভ্যাকান্সির ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। ছয় দশকের প্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ৪-৫ মুসলিম শিক্ষক। এ চরম বঞ্চনার এবার অবসান করতেই হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান সমর্থিত সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে যতটা পারা যায় রক্ষা করতে হবে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা চরম অন্যায়ভাবে বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছেন। বিষয়টি সরকারেরও ভাবা উচিত।
বর্তমান সরকারের শিক্ষামূলক গৃহীত নীতির বাস্তবয়ানের ক্ষেত্রে যে স্বচ্ছতা থাকা দরকার তা কিন্তু কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় মান্যতা দিচ্ছেনা। বর্তমান নিয়োগের ক্ষেত্রে সব কিছুই অন্ধকারে রেখে কর্তৃপক্ষ মানুষের ‘অধিকার সচেতনতা’ খর্ব করছে বলে গবেষক-গবেষিকাদের অনেকের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ছেড়ে নিয়োগ প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্তা করা হয়েছে বোস ইন্সটিটিউট কলকাতাতে। এ নিয়েও সন্দেহের ডানা বেঁধেছে। হঠাৎ কেন বোস ইন্সটিটিউটকে বাছা হোল? এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু নিয়ে নানান প্রশ্নের পাশাপাশি আইনগত চরম জটিলতাও দেখা দিতে পারে বলে অনেকের অভিমত।
এদিকে বিভিন্ন আধিকারিক ও অধ্যাপকদের আত্মীয়দের চাকরি পাইয়ে দেবার অভিযোগ উঠেছে। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুখেন বিশ্বাস উপাচার্য শঙ্কর কুমার ঘোষের অত্যন্ত স্নেহভাজন। অধ্যাপক সুখেন বিশ্বাসের স্ত্রী শ্যামশ্রী সেনগুপ্ত বিশ্বাসকে প্যানেলে রাখার জন্য তিনি প্রভাব খাটিয়েছেন। আর্টস বিভাগের ডীন অধ্যাপক তপন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ডিলিট জালিয়াতি সহ যৌন হেনস্থার অভিযোগ থাকা সত্বেও অতিদ্রুত তাকে ডীন পদে ফিরিয়ে আনা হল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাখা জন্য। অভিযোগ তিনি উপাচার্য ও আধিকারিকদের ইয়েসম্যান হিসেবে কাজ করে মন জয় করেন।
নিজেদের আত্মীয়দের স্বজনপোষণ করে চাকরি পাইয়ে দেবার অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গতকাল বাংলা বিভাগের ইন্টারভিউ ছিল। সেখানে পরীক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সুখেন বিশ্বাস ও অধ্যাপক তপন বিশ্বাসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোকজন। শোনা যাচ্ছে বিকাশ কান্তি মিদ্যা, মানস মজুমদার, উৎপল মণ্ডল, তপন বিশ্বাস, উৎপল বিশ্বাস এরা সকলেই অধ্যাপক সুখেন বিশ্বাস ও ডীন তপন কুমার বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশেষ সূত্রে গভীর পরিচিতজন। উপাচার্যের নমিনি হিসেবে পরীক্ষক হিসেবে ছিলেন রুমা ভট্টাচার্য্য, যার সঙ্গে সুখেন বিশ্বাসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যা সকলেই অবগত। সুদীপ বসু ছিলেন আচার্য্য নমিনি। তিনিও সুখেন বিশ্বাস ও তপন বিশ্বাসের অত্যন্ত সুহৃদ হিসেবে পরিচিত। এরাই পরীক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়দের চাকরি সুনিশ্চিত করতে এতো আয়োজন।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে ওবিসি সংরক্ষণ মানছে না, প্রতিবাদে ডেপুটেশন দিল যুব ফেডারেশন। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে ওবিসি সংরক্ষণ মানছে না, প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাজাবাজার বোস ইনস্টিটিউটে চলতে থাকা ইন্টারভিউয়ের দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. দেবাংশু রায়কে ডেপুটেশন দিল সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের প্রতিনিধি দল। সংগঠনের পক্ষে মহঃ কামরুজ্জামান বলেন “কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ ওবিসি –এ গোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও অ্যাসিসটেন্ট প্রফেসার পদে প্রায় ১৫০ জনকে নিয়োগ করছে যার ইন্টারভিউ শুরু হয়েছে ২৭ জুন চলবে ৭ জুলাই পর্যন্ত। যে বিজ্ঞাপন কোনভাবেই ১০০ পয়েন্ট রোস্টার মেনে করা হয়নি।
কামরুজ্জামান বলেন ইতিপূর্বে আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ২০১৪-১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন ওবিসি-এ ও কতজন ওবিসি-বি নিয়োগ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায় এ তিন বছরে একজন ওবিসি-এ ও তিনজন ওবিস-বি নিয়োগ হয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আশ্বাস দেওয়া হয় পরবর্তী নিয়োগে সংরক্ষণ নিয়ম মেনে নিয়োগ করা হবে। কিন্তু এবার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি। মহঃ কামরুজ্জামান বলেন আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন বাতিল করে ১০০ পয়েন্ট রোস্টার মেনে সংরক্ষণ নীতির বৈধতা দিয়ে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিক এবং সমস্ত শূন্যপদে নিয়োগের জন্য ইন্টারভিউ শুরু করুক। নইলে আমরা আইনেয়র রাস্তা নেব এবং মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও স্মারকলিপি তুলে দিয়ে বড় ধরনের আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যাব সংখ্যালঘুর স্বার্থ পূরণে।”
এদিনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন যুব ফেডারেশনের সহ সভাপতি বাবর হোসেন, জসীমউদ্দীন সহ অন্যান্যরা।