দৈনিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ঘুরে আসুন পূর্ব বর্ধমানের শ্রীবাটি


বুধবার,১৮/০৪/২০১৮
6674

রাহুল রায়:দৈনিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে একটু অবসর পেলেই মনটা উড়ুউড়ু করে ওঠে, ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির কাছে সেটাই স্বাভাবিক। এ রকমই এক সুযোগে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে পাড়ি দিলাম অতীতের স্মৃতিবিজড়িত এক সমৃদ্ধশালী গ্রামের দিকে। আমাদের গন্তব্য ‘শস্যের গোলা’ হিসাবে পরিচিত বর্ধমান জেলার এক গ্রাম। স্বাভাবিক ভাবেই যাত্রাপথের দু’পাশে বিস্তৃত ধানের খেত। দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝে আবার নানা রঙের রকমফের। কোথাও ঘন সবুজ, কোথাও আবার সোনালির আভা। হালকা শীতের ছোঁয়াতে, পাখির কলকাকলিতে এক মনোরম পরিবেশ। হেমন্তের সকালে সবুজ সমুদ্রের মাঝ দিয়ে কালো পিচের রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম পটে আঁকা ছবির মতো শ্রীবাটীতে।

মধ্যযুগে শ্ৰীবাটী বিখ্যাত ছিল চন্দ্ৰ-বংশের জন্য। ঘটনার প্রেক্ষাপট আজ থেকে আড়াই-তিনশ বছর আগের। নদী-বিধৌত শস্য-শ্যামলা বাংলায় তখন ভিড় জমাতে শুরু করেছে নানা জায়গা থেকে আসা ভাগ্যান্বেষীরা। সেই সময় নুনের ব্যবসা করতে গুজরাত থেকে বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন এক দল ব্যবসায়ী। নুন সেই সময় খুবই মূল্যবান ব্যবসায়িক সামগ্রী, লাভজনক; তার উপর চন্দ্রদের ব্যবসা ছিল একচেটিয়া। কাটোয়ার গঙ্গার ধারে লবণগোলাই ছিল ব্যবসার কেন্দ্র। বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদের উপকণ্ঠে কাটোয়ার তখন পর্তুগিজ, আরমানি, ইংরেজ বণিকদের ভিড়ে রমরমা অবস্থা। চন্দ্র পরিবার ক্রমশ ফুলেফেঁপে ওঠে। তাদের বাসস্থান ছিল তখন আর এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর সপ্তগ্রামে।

মরাঠা বিপ্লবের সময় যখন সপ্তগ্রাম আক্রান্ত হয়, তখন এই শাণ্ডিল্য গোত্রীয় চন্দ্রবংশের কোন এক বংশধর কুলদেবতা শ্ৰীশ্ৰীরঘুনাথজিউ ঠাকুর সঙ্গে নিয়ে বর্ধমান জেলার কৈথন গ্রামে বসবাস শুরু করেন। সেখানে নানা অত্যাচারে উত্‍পীড়িত হয়ে স্বৰ্গীয় শোভারাম চন্দ্র জমিদারি কেনেন এবং ১১৬০ বঙ্গাব্দে কুলদেবতা ও পুরোহিত-সমভিব্যাহারে কাটোয়া থানার শ্ৰীবাটী গ্রামে উঠে আসতে বাধ্য হন। তখন থেকে শ্রীবাটীর উত্তরোত্তর ‘শ্রী’ বৃদ্ধি হতে থাকে। দান-ধ্যানে শ্রীবাটির জমিদার বাড়ির তখন বঙ্গদেশে খুব সুখ্যাতি।

ঐশ্বর্য-বৈভবের ছড়াছড়ি শ্রীবাটীতে বংশধররা জলকষ্ট দূর করার জন্য বিভিন্ন গ্রামে ও জমিদারির মধ্যে ২০০ পুকুর খনন করে গেছেন। এদের কীৰ্ত্তি, নৈতিক শিক্ষা, দয়া-দাক্ষিণ্য, বিদ্যোত্‍সাহিতা, ব্যবসায়ের প্রসার সমস্ত কিছুতেই তখনকার সময়ে অতুলনীয়। একটি ঘটনার উল্লেখ করি, কোনও এক অনুষ্ঠানের পর কাঙ্গালি বিদায়ের সময় মোটা টাকার তছরুপ করে এক কর্মচারী; এই কথা তত্‍কালীন জমিদার রুক্মিণীবল্লভের কানে পৌঁছলে তিনি বলেন “যাউক সে না হয় বড় কাঙ্গালীতেই লইয়াছে”।

এ বার আসা যাক চন্দ্রবংশের এক উত্‍কৃষ্ট পুরাকীর্তির কথায়। শ্রীবাটীর চন্দ্রবাড়ির পাশেই রয়েছে টেরাকোটার কাজ সম্বলিত তিনটি শিব মন্দির। বাংলার ১২৪৩ সালে শ্রীবাটী গ্রামের জমিদারের ঠাকুর বাড়ি লাগোয়া ৭ শতক জায়গার উপর চার বছর ধরে চন্দ্র পরিবারের অর্থ থেকে প্রায় ৩ লাখ সিক্কা ব্যয়ে ২৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি পঞ্চরত্ন মন্দিরসহ (রামকানাইচন্দ্রের স্ত্রী অন্নপূর্ণা দাসীর ইচ্ছায়-১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে) আরও দুটি মন্দির তৈরি করা হয়। তখন কাশী থেকে শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত আনিয়ে শাস্ত্রীয় মতে যজ্ঞ করে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। অষ্টকোণাকৃতি এই মন্দিরগুলির সারা গায়ে রয়েছে নজরকাড়া টেরাকোটার নিখুঁত কাজ।

তিন মন্দিরের দেবতারা হলেন ভোলানাথ, চন্দ্রেশ্বর ও শিবশঙ্কর। মন্দির তৈরির কাজে দাঁইহাটের ভাস্করদের, হুগলির কাঁকড়াখুলির শিবমন্দিরের কাজ করতে আসা মিস্ত্রির দলের সাহায্যও নেওয়া হয়েছিল। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ আজও অক্ষত রয়েছে। তিনটে মন্দিরের গায়ে টেরাকোটায় চিত্রিত আছে বিভিন্ন দেব দেবীর মূর্তি, পুরান কথার নানা কাহিনি, কৃষ্ণলীলা, তখনকার সময়ে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার দৃশ্য। মন্দিরের গায়ে দেব দেবীর মূর্তিগুলির মধ্যে চামুণ্ডা কালী, মহিষমর্দিনী, জগদ্ধাত্রীর অপূর্ব মূর্তি শোভা দেখে বোঝা যায় শিল্পীর কুশলতা। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন সেই সব টেরাকোটার কাজ নানা জায়গার শিল্পীদের দিয়ে করানো হয়। টেরাকোটার সেই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মূর্তির কী অপরূপ ভঙ্গিমা, কী নিখুঁত মুখশ্রী; শিল্পীর কি অনুপম সৃষ্টি। অথচ অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই মন্দিরগুলি। কোনও হেলদোল নেই আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার। রাজ্য সরকারের প্রত্নতত্ত্ববিভাগ মন্দিরটিকে অধিগ্রহণ করলেও, মন্দিরের সংরক্ষণ হয় না। কালের গ্রাসে সুন্দর স্থাপত্যগুলি চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসী উদ্যোগী হয়ে মন্দিরগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে

কালের নিয়মে চন্দ্র বাড়ির ‘শ্রী’ আজ বিলীয়মান। জমিদার বাড়ীটি আজ ভগ্নপ্রায়। ভাবলেও অবাক হতে হয় একসময় ‘চন্দ্র’ পরিবারের এই প্রাসাদোপম বাড়িটার ভেতরে ছিল ঐশ্বর্য-বৈভবের ছড়াছড়ি, আর আজ সে নিজেই অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে। যেখানে একসময় সন্ধ্যাবেলা জ্বলে উঠত ঝাড়বাতি আজ সেখানে কুলুঙ্গির প্রদীপও নিভন্ত। অন্তঃপুরের ঘন অন্ধকারে আজ বাসা বেধেছে চামচিকের দল। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় ভগ্ন জমিদারবাড়িতে একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে আবিষ্ট হয়ে গেছিল মনটা। একাল আর সেকালের কী বিষম পার্থক্য। ধর্ম, সংস্কার আর বর্তমানের দৈন্য মিলেমিশে যেন জমিদার বাড়িটি হাহাকার করছে। রয়ে গেছে শুধু মানুষের বিশ্বাস। এ বার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। ফেরার পথে সহকর্মীদের খুনসুটিতে সুখস্মৃতি নিয়ে বাড়ী ফিরলেও মনের মধ্যে দাগ কেটে গেল ইতিহাসের সরণিতে বিস্মৃত শাশ্বত গ্রাম বাংলার এই অদি অকৃত্রিম রূপটি।

কী ভাবে যাবেন

কাটোয়া থেকে শ্রীবাটী ১৮ কিলোমিটার। বাসে বা গাড়িতে ১ ঘণ্টায় আসা যায় শ্রীবাটীতে।

কোথায় থাকবেন

সিঙ্গি গ্রামে রাস্তার ধারে তিন তলা লজ শান্তিনিকেতন। নানা মানের হোটেল ও গেস্ট হাউস রয়েছে।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট