পিয়া গুপ্তা : বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। সেই জমিদার আমল থেকে শুরুকরে এখন পর্যন্ত ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে অনেক আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে পালন হয়ে আসছে এ উৎসব। এ উৎসব যেন পুরাতন ভুল-ভ্রান্তি ভুলে সামনের দিকে এগুনোর এক অজানা শক্তি, এক অজানা সাহস। এই উৎসব যেন পুরাতন গ্লানি ও ব্যর্থতা ভুলে নতুন শুরুরআহ্বান।
প্রতি বছরে ১লা বৈশাখের অপেক্ষায় থাকি আমরা প্রত্যেকে। নতুন পোষাক পরে নিজেদের সুন্দর রূপে সজ্জিত করে আমরা বেরিয়ে পরি পয়লা বৈশাখের বিকালে।কিন্তু আমরা সবাই কি জানি এই পহেলা বৈশাখের ইতিহাস?
চৈত্রসংক্রান্তির চৈত্র মাসের শেষদিনটির গোধূলী লগ্নে ধূলো উড়িয়ে লাল সূর্যটা ডুবে গিয়ে যেন এক নতুন দিনের আগমনী বার্তা এক নতুন ইতিহাস বযে আনে!
গ্রামে গঞ্জের পাইকারী ব্যবসায়ীরা এদিন সকল ক্রেতার কাছ থেকে পুরনো বছরের হিসাব বুঝে নিয়ে লক্ষী গনেশের আরাধনা করে সকল কে মিষ্টিমুখ করিয়ে বছরের নতুন খাতা খোলে।
উল্লেখিত জনের মতো অনেকেই জানে না বৈশাখের ইতিহাস, বৈশাখের ঐতিহ্য, বৈশাখের আবেদন একজন বাঙালীর জীবনে কতটুকু। বৈশাখ বাঙালীর জীবনে এমনি এমনি আসেনি। এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি বারবার চেষ্টা করেছে বৈশাখের ঐতিহ্যকে রুখে দিতে, তার ইতিহাসকে ধ্বংস করতে। কিন্ত ইতিহাস বলে, যার হাত দিয়ে বৈশাখ কিংবা বাংলা নববর্ষের গোড়াপত্তন হয়েছে তিনি কেবল মুসলমানই ছিলেন না বরং সারা মুসলিম বিশ্বে একজন নামকরা, উদারপন্থি শাসক হিসেবে আজও পরিচিত। সেই জালালুদ্দিন মুহাম্মদ আকবরের শাসনভার গ্রহনের আগে মুঘল আমলের পুরোটা সময় ধরেই কৃষিখাজনা আদায় হতো হিজরী সনের হিসাবে।
হিজরী সন নির্ধারিত হয় চাঁদের হিসাব অনুযায়ী, কিন্ত উপমহাদেশের সারা বছরের কৃষিকাজ চাঁদের সাথে অতোটা সম্পর্কায়িত নয়, যে কারণে কৃষকেরা তখন খাজনা প্রদানে নানা প্রতিকূলতার সন্মুখীন হতো। যথাসময়ে যথাযোগ্য খাজনা আদায়ের অভিপ্রায়ে তখন সম্রাট আকবর তাঁর সভার বিশিষ্ট গুণীজন ফাতেউল্লাহ্ সিরাজীকে দিয়ে হিজরী চন্দ্রাব্দ এবং বাংলা পঞ্জিকার সমণ্বয়ে “বাংলা বছর”-এর প্রচলন করেন, যা “ফসলী সন” নামে ১৫৮৪ এর মার্চ মাসে প্রবর্তিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৫৫৬ সালে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিনটি থেকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বছরের সূত্রপাত হয়। সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলা নতুন বছরাগমনের অর্থাৎ বৈশাখের প্রথম দিনটির উৎসবমূখর উদযাপন হয়ে আসছে।
এদিন বহু বাঙালি পাঞ্জাবী পরিহিত ছেলেদের পাশে খোঁপায় বেলী ফুলের মালায় সজ্জ্বিত হয়ে, লাল পেড়ে সাদা শাড়ীর তরুণীরা মেতে ওঠে “ইলিশ-পান্তা” উৎসবে। গ্রামাঞ্চলও কোনদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই “পহেলা বৈশাখ” উদযাপনে। জায়গায় জায়গায় বসে মেলা হরেক রকম জিনিষের পসরা সাজিয়ে। বাড়ি বাড়ি তৈরী হয় মিষ্টি, নতুন চালের পায়েস ইত্যাদি। এখনো কিছু কিছু গ্রামে এই নববর্ষ উপলক্ষে এলাকার কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। নববর্ষ বর্তমানে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে।