স্মৃতিটুকু_থাক


সোমবার,১৯/০২/২০১৮
2169

স্মৃতিটুকু_থাক

চোখ বুজলেই উলুর শব্দটা কানে ভেসে আসে..একটু অন্যরকম করে উলু দিত মা,বেশ একটা সুরেলা টান থাকত প্রতিবার উলুধ্বনির শেষে..অনেকক্ষণ কানে লেগে থাকত সেই রেশ..ঠাম্মা বলত জোকার দেওয়া..ওদের ভাড়াবাড়ির উঠোনটাও কিন্তু বেশ বড়ই ছিল..খিড়কি দিয়ে ঢুকে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে বাঁধানো সিলিণ্ডার কল..খুব নরম ছিল কলটা..সৌম্য যখন চার-পাঁচ বছরের তখন মায়ের সাথে সাথে কলতলায় যেত..মা বাসন মাজত আর ও কল টিপত..খুব বকত মা আগে আগে..সৌম্য কিছুতেই শুনত না..প্রায় শুয়ে পড়ে কল টিপত ও..একবার দোলের সময় মনে হয়..হ্যাঁ,তা দোল-ই হবে..অনেকদিন হয়েও গেল..প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর..চুরানব্বই কি পঁচানব্বই সাল হবে..ঠিক মনেও পড়ে না ..তা,সেই একবার দোলের দিন সবাই তো ভূতের বাচ্চা সেজে বাড়ি ঢুকেছিল..মায়ের খিলখিল হাসিটা যেন এখনো কানে বাজে..বাবা ঘাড় ধরে কলতলায় বসিয়ে সারাগায়ে সাবান ডলেছিল..দু’চোখ টিপে কাঠের পুতুলের মত বসেছিল ও..কিন্তু তাও লাইফবয়ের ফেনা..ওফ্!!ষাঁড়ের মত চিল্লেছিল সেবার..কলতলা থেকে ডানদিকে এগিয়ে বাঁধানো তুলসীমঞ্চ..ঠাম্মা পূজোর বাসন কিছুতেই কলপাড়ে মাজত না..”আইঠ্যায় ভরা..পূজার বাসন ওইহানে মাজুম না কিসুতেই..”..ঢাকার মেয়ে ঠাম্মা..দাদু অবশ্য বাবা যেবার মাধ্যমিক দেয় সেবার-ই..ঐ তুলসীমঞ্চের সামনে বসেই ঠাম্মা বাসন মাজত..শনিবার করে লুট দিত ঠাম্মা,”শনিপ্রীতে বলো হরি”..ঠাম্মার কাঁপাকাঁপা গলার সাথে তারস্বরে একটা কচি গলা রিনরিনিয়ে উঠতো তখন..”হরিবোল”..প্রসাদ খেয়ে কলপাড় থেকে পা ধুয়ে ঘরে ঢুকত ওরা..মা সন্ধ্যা দিত..একটু কুঁজো হয়ে ঠাম্মা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকত..নীচু হয়ে ঠাম্মার পা ছুঁত মা..মাথার ঘোমটাটা একটু সরে যেত তখন..কাঁপাকাঁপা হাতটা মায়ের মাথায় রাখত ঠাম্মা..”বাইচ্যে থাহো,সুহে থাহো..”..শাঁখটা রেখে উলু দেওয়াও শেষ হলো আর বাবার সাইকেলের ঘন্টিও বাজল..মায়ের চোখ বুঁজে প্রণামরত মুখটা কেমন যেন আলো আলো হয়ে যেত ঐ সময়টা..ছোট্ট সৌম্য..না তো..সমু..সমু ছিল ও..সৌম্য তো এখন হয়েছে..সমু ছুটে যেত গেট খুলতে..রংচটা সাইকেলের সাথেসাথে বাবার হাসিমুখ বাড়িতে ঢুকত..বি.ডি.ও অফিসে সামান্য একটা চাকরী করত বাবা..ছোঁ মেরে সাইকেলের রডে ঝোলানো পুরনো হাতে বোনা সূতির ব্যাগটা তুলে নিত সমু..মুখ খুলতেই কোনদিন সিঙ্গারা কোনদিন সদ্যভাজা জিলিপি নয়ত রসুন দেওয়া আলুর চপ..ফলস্বরূপ রাতে চোঁয়া ঢেকুর!!মা একগাদা কাঁচা ঝালঝাল আদা গিলিয়ে দিত বাবার ওপর গজগজ করতে করতে..আর নয়ত ঠাম্মার দেরাজ থেকে ভাস্কর লবণ!!অম্বলের অব্যর্থ দাওয়াই!!জেলুসিল,পুদিনহারার তখন কোন জায়গা ছিল না ওদের জীবনে..এক একদিন অবশ্য কলা পেঁপেও আনত বাবা..বড় বিরস কাটত সেই সন্ধ্যাগুলো!!কলা পেঁপে যা-ই আসুক,কয়েক টুকরো মা ঠিক দোতলায় দিয়ে আসবেই..বাড়িওয়ালা আর ওনার স্ত্রী-মেয়ে সব দোতলাতে থাকতেন..একটা ছেলেও ছিল ওনাদের..অনেকদূরে কোথায় যেন চাকরি করত..দু’একবার হয়ত দেখেওছিল সমু..এখন আর মুখটাও মনে নেই..ছোট্ট সমু বহুদিন পর্যন্ত জানতই না ওনারা সমুর নিজের দাদু-দিদা নন..মাথাভরা টাক ছিল দাদুর..দিদারও সামনে মাত্র তিন-চার গাছি..তাই দিয়েই টেনে এইটুকুনি একটা বড়ির মত খোঁপা বাঁধত দিদা..সবসময় পান খেত..টুকটুকে ঠোঁট আর মুখভরা হাসি..সমু ডাকত টাকিদিদা আর টাকিদাদু..খুব বকত মা..কয়েকবার পিটিয়েওছে..দাদু-দিদা কিন্তু খুব হাসত..কোনদিন রাগ করেনি..আর ছিল একজন..আলুর চপ হলেই মা ডাক দিত দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে..আর সে হাসিমুখে নেমে আসত..নীলাপিসি..কিন্তু নীলাপিসির কথা..যাক গে..যাক গে..নীলাপিসি এসেই আগে বুনুকে চটকাত..বুনু তখন গুল্লু একটা বাচ্চা..সাত-আট মাস হবে হয়ত..সমুই তো তখন পুঁচকে বাচ্চা..সদ্য মা বাড়িতেই ন্যাড়া করে দিয়েছে..নাপিত খরচ লাগেনি!!সে এক যুদ্ধ!!সমু সারা বাড়ি পালিয়ে বেড়াচ্ছে..আর পিছনপিছন মা সেই কমলা বাঁটের ঢাউস কাঁচিটা নিয়ে দৌড়াচ্ছে!ন্যাড়া হলে নাকি চুল ঘন হয়!!মায়ের শিল্পকীর্তি শেষ হওয়ার পর কাঠের আলমারির গায়ে লাগান লম্বাটে আয়নাটায় নিজেকে দেখে একঘন্টা ভ্যাঁও ভ্যাঁও করেছিল সমু!!কাকের বাচ্চার মত লাগছিল পুরো!!মাথাটা কদমফুলের মত..খড়খড়ে..বাবা প্রায় মাসখানেক সমুর মাথায় ঘষে ঘষে হাত চুলকাতো!!রাগের চোটে বহুদিন আয়না দেখত না ও..আয়নাটার দু’এক জায়গা একটু চিড় ধরে গেছিল..বাবা বলত মাঝেমাঝেই নতুন আয়না কেনার কথা..কে জানে কেন মা কিছুতেই কিনতে দিত না..মায়ের বিয়েতে দাদু দিয়েছিল ওটা..আর একটা উঁচু খাট..অনেক ছুটির দুপুরে শুকতারা চাঁদমামা নিয়ে ব্যস্ততার অবসরে মা’কে আয়নাটা মুছতে দেখেছে সমু..হ্যাণ্ডেলে লাল কালো ফিতে জড়ানো..একদম ওপরের দিকটায়,অত উঁচুতে সমুর হাত যেতনা..ওখানটায় লাল লাল টিপ লাগানো থাকত..আঠায় আঠায় জায়গাটা কালচে হয়ে গেছিল..তাও মা আয়নাটা পাল্টাতে চাইত না..কাউকে কি খুঁজত মা ওটার মধ্যে??মরে যাওয়া বাবাকেই কি খুঁজত??

                                                                                          ***
     বুনুকে একটা নুপূর বানিয়ে দিয়েছিল টাকিদিদা..সরুউউ জিলজিলে রুপোর দু’গাছা সুতো,চারপাশ দিয়ে কি’রম যেন বলের মতো গোল্লাগোল্লা..আবার ঝুমুরঝুমুর শব্দও হত..বুনুটা সদ্যসদ্য হাঁটতে শিখেছে তখন..আধোআধো করে কথাও বলতে পারত..একটা লাল টুকটুকে জুতো কিনে দিয়েছিল বাবা,হাঁটলে প্যাঁকপ্যাঁক করে শব্দ হত..কল্যাণীতে সতীমা’র মেলায় এসেছিল সমুরা একবার..ট্রেনে সেদিন দম আটকানো ভীড়..ঠাম্মাকে টাকিদিদার জিম্মায় রেখে ওরা চারজন এসেছিল..ঠাম্মা অত ধকল নিতে পারত না আর..যাওয়ার সময় ভালোই গেছিল,ফেরার সময়..ভীড় কাকে বলে!বাপস্!!কোনরকমে টেনেহিঁচড়ে তিনজনকে নামানোর পর দেখা গেল বুনুর পায়ের একগাছা নুপূর হাপিস!!মা কাঁদোকাঁদো,বাবা চুপ,বুনু হাসিহাসি!দিব্যি দুধে দাঁত দেখিয়ে হেসেটেসে বলল একটা মামা পা থেকে একটা ‘ঝুম'(বুনু নুপূরকে পায়ের ঝুম বলত)খুলে নিয়েছে..বুনু আরেকটা পা’ও বাড়িয়ে দিয়েছিল..মামাটা নেয়নি..বুনুর ভাষায় ‘ছুন্দর মামা’!টাকিদিদা আরেকটা গড়িয়ে দিতে চেয়েছিল,মা খুব রাগারাগি করায় পারেনি আর..নুপূরটা বহুদিন অবধি মায়ের আলমারিতে ছিল..তারপরে যে কোথায় গেল..কে জানে।
                                                                                            ***
     সমুকে নিয়ে বাবা স্যারের বাড়ি গেছিল একদিন,একটা লুঙ্গি আর সাদা গেঞ্জি পরে বাড়ির সামনের ঘাসগুলো পরিষ্কার করছিলেন স্যার..বাবার আর্জি শুনে একঝলক সমুকে দেখে নির্বিকারমুখে ঘাস ছাঁটছিলেন..বুকের মধ্যে ধুকপুকানি..বাবার পিছন থেকে খরগোশের মত মুখ বাড়িয়েছিল সমু..কিছুক্ষণ পর সমুর দিকে তাকিয়েছিলেন স্যার..”নেতাজীর নাম শুনেছ??”সমু চুপ..শুধু চোখের সামনে দিয়ে ঠাম্মার ঠাকুরের সিংহাসন উঁকি দিয়ে গেল..বাবা পিঠে খোঁচা মারছে..স্যার একমনে ঘাস ছেঁটে যাচ্ছেন..বিড়বিড় করল সমু..”এঁ,উঁ,উম..ঠাকুর হয়,খুব বড় ঠাকুর,ঠাম্মা রোজ পূজো করে..জ্যান্ত দেখেছিল দাদু,ঠাম্মা গল্প বলেছে..এখন লুকিয়ে আছে..কিন্তু ঠাম্মা বলেছে শিগগিরি আসবে..তখন সব ঠিক হয়ে যাবে..”বাবার মুখ ফ্যাকাশে..এতদিনের এত পরিশ্রম সব জলে!!মরিয়া বাবা..”ইয়ে মানে স্যার,ও সব জানে..আসলে ভয়ের চোটে..”নিড়ুনিটা থামিয়ে ওদের দেখছিলেন স্যার..বাঁ-হাতটা তুলে বাবাকে থামিয়ে দিলেন..”তোমার বন্ধুর বাড়িতে আজ রান্না হয়নি,ওর খুব খিদে পেয়েছে..কিন্তু ওর মা’র খুব জ্বর আর ওর বাবাও রান্না করতে পারেন না..কি করবে তুমি??”মুখটা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল সমুর..”আমার মা খুব ভালো আলুসিদ্ধ মাখতে পারে তো,আমাকে মাংসের মেটে বেছে দেয়,একটুও ঝাল লাগেনা..ঠাম্মার ঘরে আমের আচার আছে….”একদৃষ্টে ওকে দেখছিলেন স্যার..”কিন্তু ওর তো খিদে পেয়েছে..”..আবার চুপসে গেল সমু..”বাবার সাইকেল আছে তো,সবাইকে নিয়ে আসবে..ঠাম্মার কাছে ঘুমাব সবাই..ঠাম্মা রাতে গল্প বলে..”বিড়বিড় করতে করতে চুপ করে গেল ও..একটু চুপ করে থেকে বাবার দিকে তাকিয়েছিলেন স্যার..”কাল ফার্স্ট আওয়ারে চলে যাবেন..অফিসঘরে বললেই হবে..ক্লাশ ওয়ান..আমি বলে রাখব..আচ্ছা,এখন তাহ’লে..আমি একটু বেরোব..”নিড়ুনিটা আবার সচল হয়ে উঠল..চলে আসতে আসতে একবার ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরেছিল ছোট্ট সমু..স্যার এইদিকেই তাকিয়েছিলেন..কিন্তু আজ প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বছর পরেও সেই দৃষ্টির অর্থভেদ করতে পারেনি ও..না সমু পেরেছিল..না সৌম্য পারল..
                                                                                              ***
      ছোট্ট ছিল ইস্কুলবাড়িটা..জায়গায় জায়গায় ইঁট বের করা..লালরংটা একটু ম্লান হয়ে গেছিল..পাশের বাড়ির বাবলু,সামনের বাড়ির টুনি,অনীতা..ওরা সবাই একসাথে বসত,টিফিনে হুটোপাটি করে খেলত। পুরো এইট অবধি-ই পড়েছিল সমু..তারপরেই বাবার বদলি..আর,আর..শেষের শুরু..ইস্কুলের ঠিক পাশেই হারুজেঠুর দোকান,কখনো কখনো জেম্মাও বসত এসে,দোকানের লাগোয়া টালির চালের বাড়ি ছিল ওদের..কি সুন্দর সুন্দর লাল নীল মাছ লজেন্স পাওয়া যেত..স্বচ্ছ সেলোফেনে মোড়া আচার,লম্বা সরু সরু চুরুটের মত দেখতে একরকম জিনিস পাওয়া যেত,ভিতরে মশলা,ঝাল ঝাল..জিভে টকাটক আওয়াজ তুলে খেত সমু..কতবার টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে এনে মাকেও খাইয়েছে..বাবার সাইকেলে চড়ে ইস্কুল যেত..সিট থেকে নামিয়ে একটাকার কয়েন দিত বাবা..টিফিন খরচ!যতক্ষণ পর্যন্ত সমু ক্লাশে না ঢুকত,বাবা ঠিক দাঁড়িয়ে থাকত!একবার ঠাম্মাকে হারুজেঠুর দোকান থেকে কারেন্ট নুন এনে জোর করে খাইয়েছিল..সাতদিন ঠাম্মার বাঁধানো দাঁত টকে ছিল..!!সমুর পিঠে মায়ের চাপড় পড়েছিল কয়েকটা..

***

     টাকিদিদাদের ছাদটা ন্যাড়া ছিল..বহুবার রেলিং দেব দেব করেও শেষ পর্যন্ত আর দিতে পারেনি টাকিদাদু..এককোণে বিশাল বড় অ্যান্টেনা..একটা সাদা-কালো পিঠে কুঁজওলা ঢাউস টি.ভি ছিল দাদুদের..তখন কিছুদিন হল মহাভারত শুরু হয়েছে..প্রতি রবিবার শোনা যেত..’ম্যায় সময় হুঁ’..অঘোষিত কার্ফু লেগে যেত সেই সময়টা..সমুরা দলবেঁধে ওপরে যেত..দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের দিন ঠাম্মা হাউহাউ করে কাঁদছিল..”মাইয়ামাইনষ্যের উপর অইত্যাচার ভগমান কক্কণো মাইন্যা ন্যান না..নিব্বংশ হইয়্যা যাবি রে..”মা লুকিয়েলুকিয়ে চোখ মুছছিল..কিচ্ছু না বুঝেও খুব কান্না পাচ্ছিল সমুর..একেকদিন হঠাৎ কিচ্ছু ইঙ্গিত না দিয়েই টি.ভি টা ঝিরঝির করা শুরু হয়ে যেত..অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নীলাপিসি দমাস করে একটা কিল মারত টি.ভির গায়ে..একেকদিন কাজ হত..নইলে পাশের পাড়ার অজয়কাকু এসে ছাদে অ্যান্টেনায় কি একটা করত..একটু পরেই কাঁচের মত ছবি..প্রতি রোববার বিকেল চারটে না সাড়ে চারটে আজ আর মনে নেই..সিনেমা হত ফার্স্ট চ্যানেলে..উত্তম-সুচিত্রা নামক ম্যাজিকের সাথে ওখানেই প্রথম আলাপ সমুর..বুঝতো না তখন কিছুই যদিও..তখন তো ঐ,ফার্স্ট চ্যানেল আর সেকেণ্ড চ্যানেল..সেকেণ্ড চ্যানেলে হিন্দী সিনেমার গান হত,এখানেই কি প্রথম শক্তিমান দেখেছিল সমু??কি জানি,তবে এটা মনে আছে..মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিল ওর গোটা বাল্যকাল..কতবার যে বোঁবোঁ করে ঘোরার চেষ্টা করেছে..শক্তিমান কমিকস বেরোত,পাগলের মত টাকা জমাত সমু..টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে,মাকে হাত করে..কোথায় যে গেল কমিকসগুলো..হারিয়েই গেল সব..একদিন লম্বাটে নাকের ঝোপানো চুলের কালোমতো একটা ছেলের উদ্দেশ্যে টি.ভির কাঁচের গায়ে চুমু দিচ্ছিল নীলাপিসি..সমুর অবাকচোখের দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়েছিল..”এ কে জানিস??আমার জান,আমার প্রাণ..শারুক খান!!”..কিছুদিন আগেই বাজিগর রিলিজ করেছে তখন..একবার হয়েছিল মহা মুশকিল!!নীলাপিসি আর মা হিন্দীগান দেখছে..ঠাম্মাও পানের বাটা নিয়ে এসে বসেছে..নায়িকার পোশাক ছিল,ইয়ে কি বলে,কিঞ্চিৎ সংক্ষিপ্ত..ঠাম্মা কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে সমুকে নিয়ে উঠে গেল..”আ সি সি..প্যাট বাইর কইর‍্যা কি লাচনকোদন!!লজ্জাও নাই,মা বাপ তো দ্যাখতাসে না কি!!এত ধাড়ি মাইয়্যা..সি সি সি!!”মা অধোবদন..
                                                                                                  ***
     একা ওঠেনি কোনদিন ছাদে সমু..শীতকালে মায়ের সাথে সাথে দু’হাতে করে কাঁথা কম্বল বয়ে নিয়ে যেত,বুনুও ওর ছোট্ট দু’হাতে করে একটা পাতলা চাদর টেনে নিয়ে যেত..ঠাম্মাও সেদিন বাতের ব্যাথা উপেক্ষা করে ছাদে উঠত..বুনুকে কোলের কাছে নিয়ে বসে জীর্ণ সেলাইয়ের বাক্সটা বের করে হাঁক পাড়ত..”সূতাডা পরায়ে দ্যাও দাদা,কচি চোখ..দেইখ্যো,সূই ফুইট্যা না যায়..”..সূতোর ডগাটা চেটে নিয়ে চোখদুটো সরু করে সোনামুখি সূচের ডগায় গলিয়ে দিত সমু..সারাদুপুর বসে বসে কাঁথা সেলাই করত ঠাম্মা..সূচে সূতো গলাতে না পারলেও সেই সূতো দিয়ে কাঁথার গায়ে ছবি আঁকতে পারত ঠাম্মা..আছে এখনো দু’একটা..অল্প শীতে মাঝেমাঝে সাবধানে গায়ে দেয় সৌম্য..ঠাম্মাকে কি স্পর্শ করতে পারে??বোঝা যায় না..
                                                                                                   ***
      পঁচানব্বই সাল নাগাদ মনেহয়,হুমম্, তাই হবে..পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।বাবা কোথা থেকে পুরনো এক্সরে প্লেট কেটে বানানো দু’তিনটে চশমা নিয়ে এসেছিল,ছাদে উঠেছিল সবাই,কিন্তু মা কিছুতেই সমুকে সূর্য দেখতে দিচ্ছিলনা,এখন সূর্য দেখলে নাকি চোখ খারাপ হয়ে যাবে..নীচ থেকে ঠাম্মা আর টাকিদিদার যৌথ শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছিল..নীলাপিসি ঐ ঢাউস চশমাগুলো চোখে লাগিয়ে খিলখিল করে হাসছিল,সেদিন..সেদিন-ই কি..হ্যাঁ সেদিন-ই আবীরকাকু,..নীলাপিসির ছোটবেলার বন্ধু..দূরে কোথায় চাকরি করত,ছুটিতে বাড়ি এসেছিল,সেই প্রথম দ্যাখে সমু আবীরকাকুকে..সেদিন,আকাশের অলৌকিক হীরের আংটির ছটায় দু’টো ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে নতুন করে দেখেছিল..কি দেখেছিল??নিজেদের সর্বনাশ??সারাজীবনের অভিশাপ??সেদিন কিছুই বোঝেনি সমু..শুধু আকাশজোড়া অকাল গোধূলির আলোয় নরম প্রদীপের আলোর মত দুটোমুখ দেখেছিল..আঁকা হয়ে আছে যা এতবছর পরেও..
                                                                                                   ***
       সব কিছু কেমন পালটে যাচ্ছিল দ্রুত..চারপাশ,চেনা মানুষজন..দোতলার ঘর থেকে মাঝেমাঝেই চিৎকার-চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসত,মা ছুটে যেত,একটু পরে চিন্তাকুল মুখে নেমেও আসত..ঠাম্মাও মাথা নেড়ে জিভে চুকচুক আওয়াজ তুলত..শুধু কিচ্ছু বুঝত না সমু আর বুনু..নীলাপিসির কাছে যেতে পারত না সেইসময়..টাকিদিদা কেমন রাগরাগ করে বলত ওর নাকি জ্বর হয়েছে..কতদিন জ্বর থাকে মানুষের??একমাস??ইস্কুল থেকে ফেরার সময় একদিন আবীরকাকুকে দেখেছিল..কেমন ছন্নছাড়ার মত ওদের বাড়ির দোতলার দিকে তাকিয়ে আছে..সমুকে দ্যাখেনি..ঠিক সেইসময় একদিন,দুপুরের খাওয়ার পর ঠাম্মা গিয়ে শুয়ে পড়ল..একটু গড়াত মাঝেমাঝে খাওয়ার পর ঠাম্মা..একটু পরেই উঠেও পড়ত..এইদিন কিন্তু ঠাম্মা আর উঠল না,মা টের পেতে পেতে সব শেষ..তারপর?তারপর সে এক দুঃসময়ের প্রহর..ঠাম্মার কাজের আগেই এক ভোরাই বেলায় আরেকবার হাহাকার উঠেছিল বাড়িটাতে..নীলাপিসি,আবীরকাকুর হাত ধরে চিরদিনের মত ওদের চেনা পরিধির বাইরে হারিয়ে গেছিল..পিছনে ফেলে গেছিল শুধু একটা চিরকুট..অনেক খোঁজা হয়েছিল ওদের..থানা-পুলিশ,কিন্তু..টাকিদাদুর থম মেরে যাওয়া মুখটা আজো চোখে ভাসে..আর টাকিদিদার কান্না..কিছুদিন পরেই বাবার বদলি..নতুন জায়গায় এসে গুছিয়ে বসা..প্রথম প্রথম চিঠিতে যোগাযোগ ছিল..বুথ থেকে বাবা ফোন করত..সামনের ঘোষদাদুদের বাড়িতে একটা ঢাউস কালো ফোন ছিল..ওরা দিদাকে ডেকে দিত..বড় ম্লানস্বরে ওদের খোঁজ নিত দিদা..তারপর একদিন বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে বুক চেপে বসে পড়ল..হাসপাতালে দুইরাত..চলে গেল বাবা..ওলটপালট হয়ে গেছিল সেদিন ওদের ছোট্ট সংসারটা..কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হওয়ায় মা চাকরীটা পেয়েছিল বছরখানেক বাদে..গ্র‍্যাজুয়েট ছিল মা..কিন্তু মাঝের ঐ একটা বছর সব হিসেব পালটে দিয়েছিল..একেকদিন ভাত রান্না হত না,শুকনো মুড়ি চেবাত তিনজনে মিলে..সেই ঘূর্ণাবর্তের কবলে টাকিদাদু,দিদা,নীলাপিসি,রমেনস্যার,কাপাসডাঙ্গা..সব হারিয়ে গেছিল।
                                                                                            ***
       প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর কেটে গেছে মাঝে..আজ এতবছর পর সৌম্য কাপাসডাঙ্গায় যাচ্ছে..সেদিনের ছোট্ট সমু আজ একটা কলেজে পড়ায়..মা রিটায়ার করবে সামনের বছর..বুনুটার বিয়ে পরের মাসে..পুরনো ফাইল,চিঠিপত্রের মধ্যে অনেকবার ঘোষদাদুর নাম্বারটা খুঁজেছে মা..লাভ হয়নি কিছু..কোথায় হারিয়ে গেছে সব..মা অনেকবার বারণ করেছিল,টাকিদাদুদের কথায় ম্লান হেসে মাথা নেড়েছে মা..সৌম্য অবাক হয়ে তাকিয়েছিল..”তুমি কি ভাবো দাদু-দিদা আমাদের ভুলে গেছে মা??”..”ভোলার কথা না রে,ওনাদের দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারিনি..আর এখন যাওয়াটা..তাছাড়া ওনারা..” এই ‘তাছাড়া’..খুব অস্বস্তিকর একটা কথা..সব অস্বস্তি মনের কোণায় চেপে আজ বেরিয়েছে সৌম্য..সঙ্গে ব্যাগভর্তি কার্ড..
                                                                                             ***
        প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর কেটে গেছে মাঝে..আজ এতবছর পর সৌম্য কাপাসডাঙ্গায় যাচ্ছে..সেদিনের ছোট্ট সমু আজ একটা কলেজে পড়ায়..মা রিটায়ার করবে সামনের বছর..বুনুটার বিয়ে পরের মাসে..পুরনো ফাইল,চিঠিপত্রের মধ্যে অনেকবার ঘোষদাদুর নাম্বারটা খুঁজেছে মা..লাভ হয়নি কিছু..কোথায় হারিয়ে গেছে সব..মা অনেকবার বারণ করেছিল,টাকিদাদুদের কথায় ম্লান হেসে মাথা নেড়েছে মা..সৌম্য অবাক হয়ে তাকিয়েছিল..”তুমি কি ভাবো দাদু-দিদা আমাদের ভুলে গেছে মা??”..”ভোলার কথা না রে,ওনাদের দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারিনি..আর এখন যাওয়াটা..তাছাড়া ওনারা..” এই ‘তাছাড়া’..খুব অস্বস্তিকর একটা কথা..সব অস্বস্তি মনের কোণায় চেপে আজ বেরিয়েছে সৌম্য..সঙ্গে ব্যাগভর্তি কার্ড..
                                                                                              ***
        “এই সুবীর,আর কদ্দুর?কোথাও চায়ের দোকান দেখে থামো একটু..গলাটা..”..”এই এসেই গেছি দাদা..সামনেই সোনাঝুরির মোড়..তারপর ডানদিকের রাস্তাটা..”মুখের রেখাগুলো সোজা হয়ে এল সৌম্যর..সোনাঝুরির মোড়..!!কানেকানে ফিসফিসিয়ে গেল আবছা হয়ে আসা একটা গলা..একটা বুড়ো হয়ে যাওয়া রংচটা সাইকেলের জীর্ণ ঘন্টি বেল বাজিয়ে গেল,সামনের রডের সাথে লাগানো ছোট্ট সিট থেকে একটা কচি গলা কলকলিয়ে উঠল..”বাবা বাবা,ও বাবা..আমি কিন্তু আজকে দু’টো গজাই খাব..দু’টোই কিন্তু,হ্যাঁ বাবা??আর একটা বুড়ির চুল আর দু’টো জলবক..”হাহাহাহা হাসিতে সন্ধ্যার বাতাস অনেকটা রাঙ্গা হয়ে উঠেছে..”অ্যাঁ??জলবক??তুই জলবকও খাবি নাকি গুল্লাই??”..”আমি গুল্লাই না..আমি সমু..খাব না বাবা..ওটা তো বুনুর জন্য নেবো..কিনে দেবে তো বাবা??”..”দেব বাবা,সব দেব..এই তো,সোনাঝুরির মোড় এসেই গেল প্রায়..ওঃ,গুল্লাই..পল্টু’দার দোকানে জানিস,অ্যাই..অ্যাই যো,প্রায় আমার মুঠোর সাইজের সিঙ্গারা ভাজে রে..উরেঃ!!তোর মাও খুব ভালোবাসে..চল,আগে গিয়ে বাপ-ব্যাটায় দু’টো করে সাঁটাই..তারপর তোর কি যেন বলে,হ্যাঁ..বুড়ির চুল,গজা,বকের বাচ্চা..সব হবে!!”..”ধুর বাবা!!বকের বাচ্চা না গো,জলবক!!”..দু’টো গলার হাসি সৌম্যকে ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল..একঝলক দমকা হাওয়ার মত..চোখদুটো বুজেই আছে সৌম্য..”ঐ,কি যেন বলে..(একবার গলাটা খাঁকড়িয়ে নিল,খুসখুস করছে হঠাৎ,এতক্ষণ তো ঠিক-ই ছিল..হঠাৎ কি যে..যাক গে..)..”ইয়ে,সোনাঝুরির মোড়ের কাছেই পল্টু’দার দোকান..ওখানেই দাঁড়িয়ো নাহয়..ঐ বটতলাটা আছে না..ওটার পাশেই..”…”বটতলা??কোথায় বটতলা দাদা?আর চায়ের দোকান তো..”ভ্রূ’টা একটু কুঁচকে গেছে সৌম্যর..ব্যাটার শুধু মুখেন মারিতং জগৎ!!লম্বা লম্বা বাত দেওয়ার বেলায় একেবারে..আমি সব চিনি,ল্যাঙটোবেলা থেকে গাড়ি চালাচ্ছি..ঐ রুট সব জানি..হুঁহ!!অতবড় ধুমসো বটগাছটা.. আর..যত্তসব!!”কি যে বলো,ঐ তো মোড়ের মাথাতেই..পাশেই দোকানটা..কোন দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাও ভাই??…সব চিনি সব চিনি..এই চেনো??”চুপ করে গেছে ছেলেটা..একটু বেশি-ই রিয়্যাক্ট করা হয়ে গেল নাকি রে বাবা?তোর-ই তো দোষ ভাই!!উল্টোপাল্টা বকবিও আবার..যত্তসব!আবার মনে হয় চোখটা লেগে গেছিল..আচমকা সুবীরের ডাক..”এই নিন,এই হোল সোনাঝুরির মোড়,এবার দেখান দিকি,কোথায় আপনার বটগাছ আর চায়ের..এই যো দাদা,নামুন..দেখুন একবার..”..জানলার কাঁচ আগেই নামিয়ে দিয়েছিল সৌম্য..হাঁ করে চারপাশটা গিলছিল..কবেকার,কোন জন্মের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরা সব ভীর করে আসছে..এই রাস্তা দিয়েই তো আরেকটু এগিয়ে মল্লিকদের রাসমঞ্চ..ঠাম্মার সাথে রিকশা চড়ে কতবার এসেছে..এই রাস্তার প্রতিটা ধূলোও মনেহয়..কিন্তু,কিন্তু বটগাছটা…আর পল্টু’দার দোকানটাই বা গেল কোথায়??আর এসব কি??এত এত দোকান,লোক গিজগিজ করছে..এরোম তো ছিল না!গাড়ির দরজাটা খুলে মাটিতে পা রাখল..রাস্তাটা কি চওড়া হয়েগেছে,পিচঢালা..আগে তো লাল ধুলোওড়ানো খোয়া ওঠা ছিল..বাবা খুব সাবধানে সাইকেল চালাত এখানটায়..সৌম্য পায়ে জোর পাচ্ছেনা,কাঁপছে একটু একটু..আসলে এতক্ষণ গাড়িতে টানা বসে থাকা তো..কিন্তু লম্বা কারজার্নি তো নতুন নয় ওর পক্ষে..মাকে একটা ফোন..না,থাক,আগে টাকিদাদুদের কার্ড দেওয়া হোক,তারপরে একেবারে দিদার সাথে মার ফোনে কথা বলাবে..বেশি বেলাও তো হয়নি এখনো..ওঃ,দিদা খুব কাঁদবে..এতবছর পর..কিন্তু দোকানটা..”ও দাদা,দাদা..হ্যাঁ হ্যাঁ একটু..”পাশেই টোটো স্ট্যান্ড..এখন মাত্র একটা টোটো রয়েছে..অলস ভঙ্গীতে চালক বিড়ি টানছে..তেরছা চোখে একবার সৌম্যকে মেপে বিড়িটা ফেলে টোটো নিয়ে এগিয়ে এল..”দশের কমে কিন্তু গাড়ি ছাড়ব না দাদা..ও আপনার পরে খ্যাঁচাখেঁচির থেকে..কদ্দুর যাবেন?”..”না মানে,আপনি কতদিন আছেন এখানে?”..বেচারা হাঁ করে আছে..”মানে??কতদিন আছি..আমি আজ পনেরো বছর এই লাইনে আছি..আগে রিশকা চালাতুম,এখন টোটো..আমার মত পাকা হাত..”..”না না,সেসব ঠিক আছে..ইয়ে মানে,আপনি তারমানে মোটামুটি চেনেন এই এরিয়া..”..”আরে দাদা,আপনি যাবেন কোথায় একবার বলেই দেখুন..”..”আচ্ছা,ইয়ে দাদা,এখানে যে একটা বটগাছ ছিল,সেটা কোথায় গেল??মানে এখানেই তো ছিল..আর পল্টু’দার চায়ের দোকান..চেনেন না,সেই যে সিঙ্গারা ভাজে??খুব বড় বড় বেগুনী পাওয়া যায়..”..”বটগাছ??কোন বট..ওহোহো..সেই বুড়ো বটটা??ও তো শালা বছর বারো আগে বাজ পড়েছিল ওটায়..অতবড় গাছটা পুরো ফোঁপড়া!!কিস্যু ছিল না বডিতে..তারপর তো মিউনিসিপালিটি থেকে লোক এসে একদিন..কবে কার ঘাড়ে পড়ে..আর পল্টু’দা..কোন পল্টু’দা বলুন দিকি??অনেকগুলো পল্টু তো আচে মহল্লায়..কোনটা??রোগা লম্বুমার্কা??নাকি দেড়েল বাঁটকুল??নাকি..ও,আচ্চা আচ্চা,চায়ের দোকান,না??ঐ যো,ঐ দেকুন দিকি..”টোটোওয়ালার আঙ্গুলের সোজাসুজি আচ্ছন্নভাবে তাকায় সৌম্য..বটগাছটা কেটে দিল??অ্যাঁ?সত্যি ওটা আর নেই??কত পাখী থাকত ওটায়..লাল লাল ফল ধরত,এখান দিয়ে যখন-ই যেত কি সুন্দর হাওয়া..”ও মোয়াই,অই দেকুন..আপনার পল্টুর দোকান..”সামনেই একটা জমজমাট ভাতের হোটেল,কোল্ড ড্রিঙ্কসের ছোট ফ্রিজও আছে,বিশাল কেটলিতে চা ফুটছে..সামনে সার বেঁধে গাড়ি দাঁড়িয়ে..”এই রাস্তাটা,বুঝলেন দাদা,একটু এগিয়েই সিধা বাইপাসে মিশেছে..তো,সব গাড়িই এখান দিয়েই যায়,আর এই ‘গোধূলি’ হোটেলের রান্না,ওঃ,লাজোয়াব দাদা!!আপনার পল্টু’দা,আমি তো বুইতেই পারিনি,পল্টু’দা তো বাতে পুরো কাত,নড়তে পারেনা..ঐ ছোট্ট দোকান থেকে এই হোটেল হাঁকিয়েছে..এখন ওর দুই ছেলেই দ্যাখে ট্যাখে সব..”বকবক করেই যাচ্ছে লোকটা..আচমকা ঘাড় ঘোরায় সৌম্য..”ভাই,আমাকে একটু কয়েকটা জায়গায় নিয়ে যাবেন??যা লাগবে..সুবীর তুমি একটু এখানেই চা’টা খাও..আমি এই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই..এই যে টাকা..ভালো করে টিফিন করে নিও..এই যে ভাই..চালাও তুমি..আচ্ছা,রমেন্দ্রসুন্দরী উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যাপীঠে একটু..আজ তো বুধবার..খোলাই আছে..নানা,কেউ পড়ে না,আমি নিজেই একসময়..তুমি চলো আগে..”টোটোটা চওড়া রাস্তা ধরে দূরান্তে মিলিয়ে যায়…
        “বাবা রে,সেই ছোট্ট ইঁট বের করা স্কুল..কি বিশাল বিল্ডিং হয়েছে..রংটাও তো খুব সুন্দর..আচ্ছা ভাই,রমেন স্যার তো রিটায়ার করেইছেন,এখন হেডস্যার কে??..”..”ও দাদা,ওটা না ওটা না,ওটা তো সেন্ট লজেন্স,এঃ হেঃ সেন্ট লরেন্স..ইংরিজি মিডিয়াম ইস্কুল দাদা,এরিয়ার বাচ্চারা সব ওকেনেই পড়ে..কি সোন্দর সাদা জামা লাল টাই..বিশাল খরচ পড়ার,কি এক ফাদার ডিসুজা না কে যেন হেডু..আর আপনার রমেন্দরসুন্দুরী না কি..ঐ যো,ঐ যে..আরে ইদিক দিয়ে মুণ্ডু বাড়ান,দেকেচেন??ঐ যে ইঁট বের করা,গেটটা ভাঙ্গামতো??রমেন স্যার না কে,আমি অতশত জানিনা বাওয়া,হেড দিদিমণি আচে একটা আর একটা ছোকরামত স্যার..সদ্যই চাগরী পেইচে..আর ম্যাস্টার দিয়ে হবেটাই বা কি..ইস্টুডেন্ট কই??ঐ তো হাতে গোনা কয়েকজন..সব গিয়ে সেঁদিয়েচে ঐ ইংরিজি ইস্কুলে..কি হোল দাদা,হারু জ্যাঠার দোকান??অ্যাঁ..হারুজ্যাঠা..তা দোকান একেনে ছিল বটে কিচু..কিন্তু তারপর তো সব ভেঙ্গেচুরে সুপার মার্কেট তুলেচে..দেকচেন না??বিউটি পাল্লার..মাংসের দোকান..ওকেনে জেরক্সের দোকান..বইখাতার দোকান..কি হোল..চলে যাব?নামবেন না??এত ইস্কুল ইস্কুল কচ্চিলেন..কি হলটা কি দাদা??
          “দাদা,তকন থেকে মনে হয় পাঁঁচবার টহল মারলুম..বলচি তো এটাই ঘোষপাড়া..আপনার কাকে চাই সেটা তো বলুন..আরে বিরাজমোহন ঘোষ..পুরো ঠাকুদ্দার নাম মাইরি..!!আমি তো বাপের জম্মে শুনিনি..কি..এত ফেলাট কেন?তা ফেলাট হবে না??ঐ কেমিকেল সারের ফ্যাক্টরিটা হবার পর এরিয়ার জমির দাম জানেন??ঐ দু’চার পিস গোঁয়ার পাব্লিক ছাড়া সব জমি বেচেবুচে প্রোমোটারের হাতে দিইচে..নিশ্চিন্দি!!মোটা ট্যাকা তারওপর ফেলাট..আর কি চাই দাদা??আচ্চা,আপনি একেনে আর কাউরে চেনেন না??আপনার বন্দু?কি নাম?বাবলু,টুনি,অনীতা..এই পাড়াতেই থাকত?সে দেকুন গে এদ্দিনে বে’থা হয়ে গেচে!সামনের বাড়ি..কিন্তু আপনি তো আপনার বাড়ি-ই চিনতে পারছেন না..তা সেই পুরনো পাড়া কি আর আচে?দেখচেন না চারদিকে সব বড় বড় ফেলাট!!ঐ সাইডে কয়েক ঘর পুরনো বাড়ি অবিশ্যি আচে..রমেন স্যার..ওঃহো..আমি চিনি না..অনি’দা..খ্যালে??ফুটবল..এরিয়ায় পেলেয়ার আচে আর এই সজল বারুই জানে না..আচ্চা,দাঁড়ান দাঁড়ান..এক কাজ করি..বাজারের মদ্যে অজয়ের টি.ভি.র লাইনের দোকান..আগে আগে,মানে সে বহু আগে..অ্যান্টেনা সারাতো টি.ভি.র..তারপর তো কেবল লাইন আসার পর ও-ই রাজা!!পুরো এরিয়া মুঠোর মদ্যে করে রেকেচে..ও একেনে বহুবচর আচে,আমার সাতে হেব্বি খাতির!চলেন ওরে চিনতে পারেন কিনা দেকি…
                                                                                          ***

মিনিট কুড়ি হল অজয়কাকুর দোকানে বসে আছে সৌম্য..সেদিনের সেই একগাল হাসির অজয়কাকু আজ প্রায় প্রৌঢ়..না,অজয়কাকু চিনতে পারেনি সেদিনের ছোট্ট সমুকে..সৌম্য যখন প্রাণপণে বাবার পরিচয় দিচ্ছে তখন ম্লান হেসে ঘাড় নেড়েছিল..”আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার বাড়িতে টি.ভি.র লাইন লাগিয়েছি..অত আর মাথায় থাকে না..তবে তুমি যা বলছ..বাপ-মা আর ছোটছোট ছেলেমেয়ে তো?নামধাম মনে নেই কিন্তু আবছা করে মুখ মনে আসছে..চিনেছি ঐ বাড়ি..মাসিমা,মেসোমশাই তো??একটা মেয়েও ছিল না ওনাদের?ও তো পালিয়ে..”ইতস্ততঃ করে চুপ করে গেল অজয়কাকু..সৌম্যর মাথা নীচু..”আসলে তুমি যে টাইম বললে..মানে তোমরা চলে যাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই মেসোমশাই চলে যান..শরীর একদম ভেঙ্গে গেছিল,আসলে ঐ মেয়ের দেওয়া লজ্জাটা..মাসিমা কিন্তু ছিলেন বেশ অনেকদিন..ঐ মেসোমশাইয়ের পেনশন আর বাড়িভাড়া..তারপর তো বছর দশেক হোল উনিও..ওনার ছেলে একবার-ই এসেছিল..মা মরার পর বাড়িঘর বেচেবুচে প্রোমোটারকে দিয়ে..ঐ বাড়ির জায়গায় বিশাল বড় ফ্ল্যাট এখন..গেছিলে বললে..দ্যাখোনি??ওনাদের মেয়ে..না ভাই..আমি ছাপোষা মানুষ..কাজ নিয়ে বাঁচি না..অত আর..না ভাই,যদ্দুর জানি আর ফিরে আসেনি..তুমিও ভাই আজব আছ..তোমরা যখন ছিলে তখনি মেসোমশাই প্রায় সত্তর..আর আজ প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর পর তুমি একেবারে বোনের বিয়ের কার্ড হাতে..আরে ওনারা বেঁচে থাকলেও কি আর তোমায় চিনতে পারতেন??”অভিব্যক্তিহীন মুখে বসেছিল সৌম্য..কি মহামূর্খ ও!!নিজের কল্পনার জগৎ নিয়েই এতদিন খুশি ছিল..একবার ভাবেওনি যে..”কি বলছ??রমেন স্যার..কোন রমেন স্যার..প্রাইমারী ইস্কুলটার..ওহো!!ঐ তারকাটা মাস্টার??তারকাটা ছাড়া আর কি বলব বলো??আরে জলে থেকে কেউ কুমীরের পিছনে লাগে?ছাপোষা মাস্টার,সে গেছে প্রোমোটারের সাথে লড়তে!!আরে,তোমার স্যার,ওনার বাড়ির পজিশনটা দেখেছ তো আগে??পুরো সোনায় মোড়া..তা আমাদের এম.এল.এ রাজীব স্যার,স্যারের তো প্রোমোটারীর বিজনেস..স্যার খুব ভালোভাবেই জমিটা চেয়েছিলেন..টাকা দেবেন..একটা আস্ত ফ্ল্যাট দেবেন,ল্যাংড়া ছেলেটার একটা গতিও করে দেবেন..কে ল্যাংড়া মানে??রমেনের ছেলে..ঐ,কি যেন..অনি না কি যেন নাম..খেলত আগে,দ্যাখোনি ওকে??খুব ভালো খেলত তো..কোলকাতার বড় ক্লাবে চান্সও পেয়েছিল..তারপর তো বাইক অ্যাক্সিডেন্ট..বাঁচতই না,নেহাত আয়ুর জোর..ডানপায়ের ওপর দিয়েই ফাঁড়াটা গেছে,তুমি তো আছ কিছুক্ষণ,বোসো না,এই তো,সামনে দিয়েই যাবে..একটা ক্রাচ নিয়ে ল্যাং ল্যাং করতে করতে যায়..প্রতিবন্ধী কোটায় কি এক চাকরি পেয়েছে তাই বাঁচোয়া,দু’টো খেতে পাচ্ছে,নইলে তোমার স্যারের যা কাণ্ড!!মুখের ওপর রাজীবস্যারকে বলে দিল এ আমার বাপের ভিটে..দেব না,আর আমার ছেলের চাকরির দরকার নেই,ওর বাপ বেঁচে আছে,পেনশন পায়..ওর বাপ খাওয়াবে ওকে..আপনি আসুন..তারপর?তারপর আর কি..এম.এল.এর সাথে লেগে কেউ পারে??পেনশনের রেলা কবে ঘুচেছে..পেনশন পায়-ই না..কি সব কলকাঠি নেড়ে রাজীবস্যার..এখন কটা টিউশনি করে আর ঐ খোঁড়া ছেলে বরাতজোরে কাজটা পেয়েছিল..চলে যায় একরকম..আচ্ছা ভাই,এবার আমায় বেরোতে হবে,ভালো লাগল দেখা হয়ে..পুরনো দিনের কথা,বড় ভালো লাগল..আবার কখনো এলে অবিশ্যি অবিশ্যি একবার…”
                                                                                         ***

কাঁপা হাতে কন্টাক্ট লিস্টটা স্ক্রল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সৌম্য..হচ্ছে না হচ্ছেন্ না..ঘেমো হাতে পিছলে পিছলে যাচ্ছে টাচস্ক্রিন..ঠিক সেই সময়টার মত..কখন যেন হাতের মুঠো গলে পিছলে গেছে..চৈতালি বাতাসের মত,মুঠোভরা বালির মত..দু’হাতের শক্ত মুঠোয় বন্দী হয়েও মনের অগোচরে কবে যেন হারিয়ে গেল..”হ্যাল্্লো..হ্যালো,হ্যাঁ আমি..মা,মা তুমি শুনতে পাচ্ছ?হ্যালো মা..হ্যাঁ,আওয়াজ আসছে..মা..তু..ত্তুমি জানো..মা..নেই গো..কিচ্ছু নেই,সব হারিয়ে গেছে গো..ঐ বাড়িটা,আমাদের বাড়ির ছাদটা গো মা,কিচ্ছু আর নেই..ওখানে একটা ফ্ল্যাট হয়েছে..টাকিদাদু আর দিদা..”আচমকা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো সৌম্য..সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরেধীরে নেমে আসছে..একটা-দু’টো স্ট্রীটলাইট জ্বলে উঠছে..একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভার ছেলেটি কেমন হতভম্ব হয়ে যেন দেখছে সৌম্যকে..টোটোওয়ালা পৌঁছে দিয়ে গেছে ওকে..”মরে গেছে গো..ওরা দু’জনেই মরে গেছে..আমি-ই একটা বোকামাধাই ছিলাম মা,তুমি তো বারবার বারণ করেছিলে..অনি’দার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল..তুমি জানো..অনি’দা একটা ক্রাচ নিয়ে হাঁটে মা..শুধু রমেনস্যার..”ঢোঁক গিলল সৌম্য..”স্যার আছেন…কিন্তু আ..আমি সামনে যাইনি গো..যদি চিনতে না পারেন!!খুব ভয় করছিল আ..আমার..”গলা কাঁপছে..”আর আর..নীলাপিসি..নীলাপিসির কোন…”..কেমন একটা ক্লান্ত গলা ভেসে এল..”কোন খোঁজ পাসনি তো??পাবিনা,জানতাম..ঐ,সব হারিয়েই যায়..শুধুশুধুই এত কষ্ট করলি..পাগল রে তুই..চলে আয় এবার..আমি আগেই জানতাম..”মায়ের গলাটা আর শোনা যাচ্ছেনা..সেই কার্তিকের শেষ বিকেলে অথবা নবীন সন্ধ্যায়..গাড়িতে গোছাভরা বিয়ের কার্ড পড়ে রইল..লাল কালিতে যত্নে আঁকা নামগুলো কেমন যেন বিষণ্ণ..লাল-হলুদ প্রজাপতিরা কার্ডের বুক থেকে উঠে এসে পড়ন্ত বিকেল আর আগত সন্ধ্যার সন্ধিস্থলে ডানা মেলে দিল..একা সৌম্যই শুধু একটা নেড়ামাথায় খোঁচা-খোঁচা চুল গজানো বালকের স্মৃতির হাত ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে..তাদের ঘিরে বইতে লাগল মনখারাপের বাতাস..ধীরেধীরে ভাঙ্গতে লাগল স্মৃতির ঘর..আচমকা কেঁপে উঠল সৌম্য..প্রায় ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল..”সুবীর,চালাও শিগগির..একটু জোরে,হ্যাঁ ভাই??..”..দাদা,শরীর ঠিক আছে তো..একটু চা খেয়ে নিতেন না’হয়..”..”না না,সব ঠিক আছে..পথে কোথাও হবে..তুমি এখন চালাও..”গাড়ি চলতে শুরু করেছে বেশ কিছুক্ষণ হোল..খোলা জানলা দিয়ে সাঁইসাঁই করে হাওয়া ঢুকছে..কাঁপা হাতে কাঁচ তুলে দিল সৌম্য..কে জানে..খোলা জানালা দিয়ে যদি বাকী স্মৃতিটুকুও হারিয়ে যায়??থাক..নাহয় স্মৃতিটুকুই থাক…
                                                                                       -সমাপ্ত-

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট