***
পঁচানব্বই সাল নাগাদ মনেহয়,হুমম্, তাই হবে..পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।বাবা কোথা থেকে পুরনো এক্সরে প্লেট কেটে বানানো দু’তিনটে চশমা নিয়ে এসেছিল,ছাদে উঠেছিল সবাই,কিন্তু মা কিছুতেই সমুকে সূর্য দেখতে দিচ্ছিলনা,এখন সূর্য দেখলে নাকি চোখ খারাপ হয়ে যাবে..নীচ থেকে ঠাম্মা আর টাকিদিদার যৌথ শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছিল..নীলাপিসি ঐ ঢাউস চশমাগুলো চোখে লাগিয়ে খিলখিল করে হাসছিল,সেদিন..সেদিন-ই কি..হ্যাঁ সেদিন-ই আবীরকাকু,..নীলাপিসির ছোটবেলার বন্ধু..দূরে কোথায় চাকরি করত,ছুটিতে বাড়ি এসেছিল,সেই প্রথম দ্যাখে সমু আবীরকাকুকে..সেদিন,আকাশের অলৌকিক হীরের আংটির ছটায় দু’টো ছেলে-মেয়ে পরস্পরকে নতুন করে দেখেছিল..কি দেখেছিল??নিজেদের সর্বনাশ??সারাজীবনের অভিশাপ??সেদিন কিছুই বোঝেনি সমু..শুধু আকাশজোড়া অকাল গোধূলির আলোয় নরম প্রদীপের আলোর মত দুটোমুখ দেখেছিল..আঁকা হয়ে আছে যা এতবছর পরেও..
***
প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর কেটে গেছে মাঝে..আজ এতবছর পর সৌম্য কাপাসডাঙ্গায় যাচ্ছে..সেদিনের ছোট্ট সমু আজ একটা কলেজে পড়ায়..মা রিটায়ার করবে সামনের বছর..বুনুটার বিয়ে পরের মাসে..পুরনো ফাইল,চিঠিপত্রের মধ্যে অনেকবার ঘোষদাদুর নাম্বারটা খুঁজেছে মা..লাভ হয়নি কিছু..কোথায় হারিয়ে গেছে সব..মা অনেকবার বারণ করেছিল,টাকিদাদুদের কথায় ম্লান হেসে মাথা নেড়েছে মা..সৌম্য অবাক হয়ে তাকিয়েছিল..”তুমি কি ভাবো দাদু-দিদা আমাদের ভুলে গেছে মা??”..”ভোলার কথা না রে,ওনাদের দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারিনি..আর এখন যাওয়াটা..তাছাড়া ওনারা..” এই ‘তাছাড়া’..খুব অস্বস্তিকর একটা কথা..সব অস্বস্তি মনের কোণায় চেপে আজ বেরিয়েছে সৌম্য..সঙ্গে ব্যাগভর্তি কার্ড..
***
“এই সুবীর,আর কদ্দুর?কোথাও চায়ের দোকান দেখে থামো একটু..গলাটা..”..”এই এসেই গেছি দাদা..সামনেই সোনাঝুরির মোড়..তারপর ডানদিকের রাস্তাটা..”মুখের রেখাগুলো সোজা হয়ে এল সৌম্যর..সোনাঝুরির মোড়..!!কানেকানে ফিসফিসিয়ে গেল আবছা হয়ে আসা একটা গলা..একটা বুড়ো হয়ে যাওয়া রংচটা সাইকেলের জীর্ণ ঘন্টি বেল বাজিয়ে গেল,সামনের রডের সাথে লাগানো ছোট্ট সিট থেকে একটা কচি গলা কলকলিয়ে উঠল..”বাবা বাবা,ও বাবা..আমি কিন্তু আজকে দু’টো গজাই খাব..দু’টোই কিন্তু,হ্যাঁ বাবা??আর একটা বুড়ির চুল আর দু’টো জলবক..”হাহাহাহা হাসিতে সন্ধ্যার বাতাস অনেকটা রাঙ্গা হয়ে উঠেছে..”অ্যাঁ??জলবক??তুই জলবকও খাবি নাকি গুল্লাই??”..”আমি গুল্লাই না..আমি সমু..খাব না বাবা..ওটা তো বুনুর জন্য নেবো..কিনে দেবে তো বাবা??”..”দেব বাবা,সব দেব..এই তো,সোনাঝুরির মোড় এসেই গেল প্রায়..ওঃ,গুল্লাই..পল্টু’দার দোকানে জানিস,অ্যাই..অ্যাই যো,প্রায় আমার মুঠোর সাইজের সিঙ্গারা ভাজে রে..উরেঃ!!তোর মাও খুব ভালোবাসে..চল,আগে গিয়ে বাপ-ব্যাটায় দু’টো করে সাঁটাই..তারপর তোর কি যেন বলে,হ্যাঁ..বুড়ির চুল,গজা,বকের বাচ্চা..সব হবে!!”..”ধুর বাবা!!বকের বাচ্চা না গো,জলবক!!”..দু’টো গলার হাসি সৌম্যকে ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল..একঝলক দমকা হাওয়ার মত..চোখদুটো বুজেই আছে সৌম্য..”ঐ,কি যেন বলে..(একবার গলাটা খাঁকড়িয়ে নিল,খুসখুস করছে হঠাৎ,এতক্ষণ তো ঠিক-ই ছিল..হঠাৎ কি যে..যাক গে..)..”ইয়ে,সোনাঝুরির মোড়ের কাছেই পল্টু’দার দোকান..ওখানেই দাঁড়িয়ো নাহয়..ঐ বটতলাটা আছে না..ওটার পাশেই..”…”বটতলা??কোথায় বটতলা দাদা?আর চায়ের দোকান তো..”ভ্রূ’টা একটু কুঁচকে গেছে সৌম্যর..ব্যাটার শুধু মুখেন মারিতং জগৎ!!লম্বা লম্বা বাত দেওয়ার বেলায় একেবারে..আমি সব চিনি,ল্যাঙটোবেলা থেকে গাড়ি চালাচ্ছি..ঐ রুট সব জানি..হুঁহ!!অতবড় ধুমসো বটগাছটা.. আর..যত্তসব!!”কি যে বলো,ঐ তো মোড়ের মাথাতেই..পাশেই দোকানটা..কোন দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাও ভাই??…সব চিনি সব চিনি..এই চেনো??”চুপ করে গেছে ছেলেটা..একটু বেশি-ই রিয়্যাক্ট করা হয়ে গেল নাকি রে বাবা?তোর-ই তো দোষ ভাই!!উল্টোপাল্টা বকবিও আবার..যত্তসব!আবার মনে হয় চোখটা লেগে গেছিল..আচমকা সুবীরের ডাক..”এই নিন,এই হোল সোনাঝুরির মোড়,এবার দেখান দিকি,কোথায় আপনার বটগাছ আর চায়ের..এই যো দাদা,নামুন..দেখুন একবার..”..জানলার কাঁচ আগেই নামিয়ে দিয়েছিল সৌম্য..হাঁ করে চারপাশটা গিলছিল..কবেকার,কোন জন্মের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিরা সব ভীর করে আসছে..এই রাস্তা দিয়েই তো আরেকটু এগিয়ে মল্লিকদের রাসমঞ্চ..ঠাম্মার সাথে রিকশা চড়ে কতবার এসেছে..এই রাস্তার প্রতিটা ধূলোও মনেহয়..কিন্তু,কিন্তু বটগাছটা…আর পল্টু’দার দোকানটাই বা গেল কোথায়??আর এসব কি??এত এত দোকান,লোক গিজগিজ করছে..এরোম তো ছিল না!গাড়ির দরজাটা খুলে মাটিতে পা রাখল..রাস্তাটা কি চওড়া হয়েগেছে,পিচঢালা..আগে তো লাল ধুলোওড়ানো খোয়া ওঠা ছিল..বাবা খুব সাবধানে সাইকেল চালাত এখানটায়..সৌম্য পায়ে জোর পাচ্ছেনা,কাঁপছে একটু একটু..আসলে এতক্ষণ গাড়িতে টানা বসে থাকা তো..কিন্তু লম্বা কারজার্নি তো নতুন নয় ওর পক্ষে..মাকে একটা ফোন..না,থাক,আগে টাকিদাদুদের কার্ড দেওয়া হোক,তারপরে একেবারে দিদার সাথে মার ফোনে কথা বলাবে..বেশি বেলাও তো হয়নি এখনো..ওঃ,দিদা খুব কাঁদবে..এতবছর পর..কিন্তু দোকানটা..”ও দাদা,দাদা..হ্যাঁ হ্যাঁ একটু..”পাশেই টোটো স্ট্যান্ড..এখন মাত্র একটা টোটো রয়েছে..অলস ভঙ্গীতে চালক বিড়ি টানছে..তেরছা চোখে একবার সৌম্যকে মেপে বিড়িটা ফেলে টোটো নিয়ে এগিয়ে এল..”দশের কমে কিন্তু গাড়ি ছাড়ব না দাদা..ও আপনার পরে খ্যাঁচাখেঁচির থেকে..কদ্দুর যাবেন?”..”না মানে,আপনি কতদিন আছেন এখানে?”..বেচারা হাঁ করে আছে..”মানে??কতদিন আছি..আমি আজ পনেরো বছর এই লাইনে আছি..আগে রিশকা চালাতুম,এখন টোটো..আমার মত পাকা হাত..”..”না না,সেসব ঠিক আছে..ইয়ে মানে,আপনি তারমানে মোটামুটি চেনেন এই এরিয়া..”..”আরে দাদা,আপনি যাবেন কোথায় একবার বলেই দেখুন..”..”আচ্ছা,ইয়ে দাদা,এখানে যে একটা বটগাছ ছিল,সেটা কোথায় গেল??মানে এখানেই তো ছিল..আর পল্টু’দার চায়ের দোকান..চেনেন না,সেই যে সিঙ্গারা ভাজে??খুব বড় বড় বেগুনী পাওয়া যায়..”..”বটগাছ??কোন বট..ওহোহো..সেই বুড়ো বটটা??ও তো শালা বছর বারো আগে বাজ পড়েছিল ওটায়..অতবড় গাছটা পুরো ফোঁপড়া!!কিস্যু ছিল না বডিতে..তারপর তো মিউনিসিপালিটি থেকে লোক এসে একদিন..কবে কার ঘাড়ে পড়ে..আর পল্টু’দা..কোন পল্টু’দা বলুন দিকি??অনেকগুলো পল্টু তো আচে মহল্লায়..কোনটা??রোগা লম্বুমার্কা??নাকি দেড়েল বাঁটকুল??নাকি..ও,আচ্চা আচ্চা,চায়ের দোকান,না??ঐ যো,ঐ দেকুন দিকি..”টোটোওয়ালার আঙ্গুলের সোজাসুজি আচ্ছন্নভাবে তাকায় সৌম্য..বটগাছটা কেটে দিল??অ্যাঁ?সত্যি ওটা আর নেই??কত পাখী থাকত ওটায়..লাল লাল ফল ধরত,এখান দিয়ে যখন-ই যেত কি সুন্দর হাওয়া..”ও মোয়াই,অই দেকুন..আপনার পল্টুর দোকান..”সামনেই একটা জমজমাট ভাতের হোটেল,কোল্ড ড্রিঙ্কসের ছোট ফ্রিজও আছে,বিশাল কেটলিতে চা ফুটছে..সামনে সার বেঁধে গাড়ি দাঁড়িয়ে..”এই রাস্তাটা,বুঝলেন দাদা,একটু এগিয়েই সিধা বাইপাসে মিশেছে..তো,সব গাড়িই এখান দিয়েই যায়,আর এই ‘গোধূলি’ হোটেলের রান্না,ওঃ,লাজোয়াব দাদা!!আপনার পল্টু’দা,আমি তো বুইতেই পারিনি,পল্টু’দা তো বাতে পুরো কাত,নড়তে পারেনা..ঐ ছোট্ট দোকান থেকে এই হোটেল হাঁকিয়েছে..এখন ওর দুই ছেলেই দ্যাখে ট্যাখে সব..”বকবক করেই যাচ্ছে লোকটা..আচমকা ঘাড় ঘোরায় সৌম্য..”ভাই,আমাকে একটু কয়েকটা জায়গায় নিয়ে যাবেন??যা লাগবে..সুবীর তুমি একটু এখানেই চা’টা খাও..আমি এই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই..এই যে টাকা..ভালো করে টিফিন করে নিও..এই যে ভাই..চালাও তুমি..আচ্ছা,রমেন্দ্রসুন্দরী উচ্চপ্রাথমিক বিদ্যাপীঠে একটু..আজ তো বুধবার..খোলাই আছে..নানা,কেউ পড়ে না,আমি নিজেই একসময়..তুমি চলো আগে..”টোটোটা চওড়া রাস্তা ধরে দূরান্তে মিলিয়ে যায়…
“বাবা রে,সেই ছোট্ট ইঁট বের করা স্কুল..কি বিশাল বিল্ডিং হয়েছে..রংটাও তো খুব সুন্দর..আচ্ছা ভাই,রমেন স্যার তো রিটায়ার করেইছেন,এখন হেডস্যার কে??..”..”ও দাদা,ওটা না ওটা না,ওটা তো সেন্ট লজেন্স,এঃ হেঃ সেন্ট লরেন্স..ইংরিজি মিডিয়াম ইস্কুল দাদা,এরিয়ার বাচ্চারা সব ওকেনেই পড়ে..কি সোন্দর সাদা জামা লাল টাই..বিশাল খরচ পড়ার,কি এক ফাদার ডিসুজা না কে যেন হেডু..আর আপনার রমেন্দরসুন্দুরী না কি..ঐ যো,ঐ যে..আরে ইদিক দিয়ে মুণ্ডু বাড়ান,দেকেচেন??ঐ যে ইঁট বের করা,গেটটা ভাঙ্গামতো??রমেন স্যার না কে,আমি অতশত জানিনা বাওয়া,হেড দিদিমণি আচে একটা আর একটা ছোকরামত স্যার..সদ্যই চাগরী পেইচে..আর ম্যাস্টার দিয়ে হবেটাই বা কি..ইস্টুডেন্ট কই??ঐ তো হাতে গোনা কয়েকজন..সব গিয়ে সেঁদিয়েচে ঐ ইংরিজি ইস্কুলে..কি হোল দাদা,হারু জ্যাঠার দোকান??অ্যাঁ..হারুজ্যাঠা..তা দোকান একেনে ছিল বটে কিচু..কিন্তু তারপর তো সব ভেঙ্গেচুরে সুপার মার্কেট তুলেচে..দেকচেন না??বিউটি পাল্লার..মাংসের দোকান..ওকেনে জেরক্সের দোকান..বইখাতার দোকান..কি হোল..চলে যাব?নামবেন না??এত ইস্কুল ইস্কুল কচ্চিলেন..কি হলটা কি দাদা??
“দাদা,তকন থেকে মনে হয় পাঁঁচবার টহল মারলুম..বলচি তো এটাই ঘোষপাড়া..আপনার কাকে চাই সেটা তো বলুন..আরে বিরাজমোহন ঘোষ..পুরো ঠাকুদ্দার নাম মাইরি..!!আমি তো বাপের জম্মে শুনিনি..কি..এত ফেলাট কেন?তা ফেলাট হবে না??ঐ কেমিকেল সারের ফ্যাক্টরিটা হবার পর এরিয়ার জমির দাম জানেন??ঐ দু’চার পিস গোঁয়ার পাব্লিক ছাড়া সব জমি বেচেবুচে প্রোমোটারের হাতে দিইচে..নিশ্চিন্দি!!মোটা ট্যাকা তারওপর ফেলাট..আর কি চাই দাদা??আচ্চা,আপনি একেনে আর কাউরে চেনেন না??আপনার বন্দু?কি নাম?বাবলু,টুনি,অনীতা..এই পাড়াতেই থাকত?সে দেকুন গে এদ্দিনে বে’থা হয়ে গেচে!সামনের বাড়ি..কিন্তু আপনি তো আপনার বাড়ি-ই চিনতে পারছেন না..তা সেই পুরনো পাড়া কি আর আচে?দেখচেন না চারদিকে সব বড় বড় ফেলাট!!ঐ সাইডে কয়েক ঘর পুরনো বাড়ি অবিশ্যি আচে..রমেন স্যার..ওঃহো..আমি চিনি না..অনি’দা..খ্যালে??ফুটবল..এরিয়ায় পেলেয়ার আচে আর এই সজল বারুই জানে না..আচ্চা,দাঁড়ান দাঁড়ান..এক কাজ করি..বাজারের মদ্যে অজয়ের টি.ভি.র লাইনের দোকান..আগে আগে,মানে সে বহু আগে..অ্যান্টেনা সারাতো টি.ভি.র..তারপর তো কেবল লাইন আসার পর ও-ই রাজা!!পুরো এরিয়া মুঠোর মদ্যে করে রেকেচে..ও একেনে বহুবচর আচে,আমার সাতে হেব্বি খাতির!চলেন ওরে চিনতে পারেন কিনা দেকি…
***
মিনিট কুড়ি হল অজয়কাকুর দোকানে বসে আছে সৌম্য..সেদিনের সেই একগাল হাসির অজয়কাকু আজ প্রায় প্রৌঢ়..না,অজয়কাকু চিনতে পারেনি সেদিনের ছোট্ট সমুকে..সৌম্য যখন প্রাণপণে বাবার পরিচয় দিচ্ছে তখন ম্লান হেসে ঘাড় নেড়েছিল..”আজ পর্যন্ত কয়েক হাজার বাড়িতে টি.ভি.র লাইন লাগিয়েছি..অত আর মাথায় থাকে না..তবে তুমি যা বলছ..বাপ-মা আর ছোটছোট ছেলেমেয়ে তো?নামধাম মনে নেই কিন্তু আবছা করে মুখ মনে আসছে..চিনেছি ঐ বাড়ি..মাসিমা,মেসোমশাই তো??একটা মেয়েও ছিল না ওনাদের?ও তো পালিয়ে..”ইতস্ততঃ করে চুপ করে গেল অজয়কাকু..সৌম্যর মাথা নীচু..”আসলে তুমি যে টাইম বললে..মানে তোমরা চলে যাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই মেসোমশাই চলে যান..শরীর একদম ভেঙ্গে গেছিল,আসলে ঐ মেয়ের দেওয়া লজ্জাটা..মাসিমা কিন্তু ছিলেন বেশ অনেকদিন..ঐ মেসোমশাইয়ের পেনশন আর বাড়িভাড়া..তারপর তো বছর দশেক হোল উনিও..ওনার ছেলে একবার-ই এসেছিল..মা মরার পর বাড়িঘর বেচেবুচে প্রোমোটারকে দিয়ে..ঐ বাড়ির জায়গায় বিশাল বড় ফ্ল্যাট এখন..গেছিলে বললে..দ্যাখোনি??ওনাদের মেয়ে..না ভাই..আমি ছাপোষা মানুষ..কাজ নিয়ে বাঁচি না..অত আর..না ভাই,যদ্দুর জানি আর ফিরে আসেনি..তুমিও ভাই আজব আছ..তোমরা যখন ছিলে তখনি মেসোমশাই প্রায় সত্তর..আর আজ প্রায় কুড়ি-বাইশ বছর পর তুমি একেবারে বোনের বিয়ের কার্ড হাতে..আরে ওনারা বেঁচে থাকলেও কি আর তোমায় চিনতে পারতেন??”অভিব্যক্তিহীন মুখে বসেছিল সৌম্য..কি মহামূর্খ ও!!নিজের কল্পনার জগৎ নিয়েই এতদিন খুশি ছিল..একবার ভাবেওনি যে..”কি বলছ??রমেন স্যার..কোন রমেন স্যার..প্রাইমারী ইস্কুলটার..ওহো!!ঐ তারকাটা মাস্টার??তারকাটা ছাড়া আর কি বলব বলো??আরে জলে থেকে কেউ কুমীরের পিছনে লাগে?ছাপোষা মাস্টার,সে গেছে প্রোমোটারের সাথে লড়তে!!আরে,তোমার স্যার,ওনার বাড়ির পজিশনটা দেখেছ তো আগে??পুরো সোনায় মোড়া..তা আমাদের এম.এল.এ রাজীব স্যার,স্যারের তো প্রোমোটারীর বিজনেস..স্যার খুব ভালোভাবেই জমিটা চেয়েছিলেন..টাকা দেবেন..একটা আস্ত ফ্ল্যাট দেবেন,ল্যাংড়া ছেলেটার একটা গতিও করে দেবেন..কে ল্যাংড়া মানে??রমেনের ছেলে..ঐ,কি যেন..অনি না কি যেন নাম..খেলত আগে,দ্যাখোনি ওকে??খুব ভালো খেলত তো..কোলকাতার বড় ক্লাবে চান্সও পেয়েছিল..তারপর তো বাইক অ্যাক্সিডেন্ট..বাঁচতই না,নেহাত আয়ুর জোর..ডানপায়ের ওপর দিয়েই ফাঁড়াটা গেছে,তুমি তো আছ কিছুক্ষণ,বোসো না,এই তো,সামনে দিয়েই যাবে..একটা ক্রাচ নিয়ে ল্যাং ল্যাং করতে করতে যায়..প্রতিবন্ধী কোটায় কি এক চাকরি পেয়েছে তাই বাঁচোয়া,দু’টো খেতে পাচ্ছে,নইলে তোমার স্যারের যা কাণ্ড!!মুখের ওপর রাজীবস্যারকে বলে দিল এ আমার বাপের ভিটে..দেব না,আর আমার ছেলের চাকরির দরকার নেই,ওর বাপ বেঁচে আছে,পেনশন পায়..ওর বাপ খাওয়াবে ওকে..আপনি আসুন..তারপর?তারপর আর কি..এম.এল.এর সাথে লেগে কেউ পারে??পেনশনের রেলা কবে ঘুচেছে..পেনশন পায়-ই না..কি সব কলকাঠি নেড়ে রাজীবস্যার..এখন কটা টিউশনি করে আর ঐ খোঁড়া ছেলে বরাতজোরে কাজটা পেয়েছিল..চলে যায় একরকম..আচ্ছা ভাই,এবার আমায় বেরোতে হবে,ভালো লাগল দেখা হয়ে..পুরনো দিনের কথা,বড় ভালো লাগল..আবার কখনো এলে অবিশ্যি অবিশ্যি একবার…”
***
কাঁপা হাতে কন্টাক্ট লিস্টটা স্ক্রল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সৌম্য..হচ্ছে না হচ্ছেন্ না..ঘেমো হাতে পিছলে পিছলে যাচ্ছে টাচস্ক্রিন..ঠিক সেই সময়টার মত..কখন যেন হাতের মুঠো গলে পিছলে গেছে..চৈতালি বাতাসের মত,মুঠোভরা বালির মত..দু’হাতের শক্ত মুঠোয় বন্দী হয়েও মনের অগোচরে কবে যেন হারিয়ে গেল..”হ্যাল্্লো..হ্যালো,হ্যাঁ আমি..মা,মা তুমি শুনতে পাচ্ছ?হ্যালো মা..হ্যাঁ,আওয়াজ আসছে..মা..তু..ত্তুমি জানো..মা..নেই গো..কিচ্ছু নেই,সব হারিয়ে গেছে গো..ঐ বাড়িটা,আমাদের বাড়ির ছাদটা গো মা,কিচ্ছু আর নেই..ওখানে একটা ফ্ল্যাট হয়েছে..টাকিদাদু আর দিদা..”আচমকা হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো সৌম্য..সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরেধীরে নেমে আসছে..একটা-দু’টো স্ট্রীটলাইট জ্বলে উঠছে..একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রাইভার ছেলেটি কেমন হতভম্ব হয়ে যেন দেখছে সৌম্যকে..টোটোওয়ালা পৌঁছে দিয়ে গেছে ওকে..”মরে গেছে গো..ওরা দু’জনেই মরে গেছে..আমি-ই একটা বোকামাধাই ছিলাম মা,তুমি তো বারবার বারণ করেছিলে..অনি’দার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল..তুমি জানো..অনি’দা একটা ক্রাচ নিয়ে হাঁটে মা..শুধু রমেনস্যার..”ঢোঁক গিলল সৌম্য..”স্যার আছেন…কিন্তু আ..আমি সামনে যাইনি গো..যদি চিনতে না পারেন!!খুব ভয় করছিল আ..আমার..”গলা কাঁপছে..”আর আর..নীলাপিসি..নীলাপিসির কোন…”..কেমন একটা ক্লান্ত গলা ভেসে এল..”কোন খোঁজ পাসনি তো??পাবিনা,জানতাম..ঐ,সব হারিয়েই যায়..শুধুশুধুই এত কষ্ট করলি..পাগল রে তুই..চলে আয় এবার..আমি আগেই জানতাম..”মায়ের গলাটা আর শোনা যাচ্ছেনা..সেই কার্তিকের শেষ বিকেলে অথবা নবীন সন্ধ্যায়..গাড়িতে গোছাভরা বিয়ের কার্ড পড়ে রইল..লাল কালিতে যত্নে আঁকা নামগুলো কেমন যেন বিষণ্ণ..লাল-হলুদ প্রজাপতিরা কার্ডের বুক থেকে উঠে এসে পড়ন্ত বিকেল আর আগত সন্ধ্যার সন্ধিস্থলে ডানা মেলে দিল..একা সৌম্যই শুধু একটা নেড়ামাথায় খোঁচা-খোঁচা চুল গজানো বালকের স্মৃতির হাত ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে..তাদের ঘিরে বইতে লাগল মনখারাপের বাতাস..ধীরেধীরে ভাঙ্গতে লাগল স্মৃতির ঘর..আচমকা কেঁপে উঠল সৌম্য..প্রায় ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল..”সুবীর,চালাও শিগগির..একটু জোরে,হ্যাঁ ভাই??..”..দাদা,শরীর ঠিক আছে তো..একটু চা খেয়ে নিতেন না’হয়..”..”না না,সব ঠিক আছে..পথে কোথাও হবে..তুমি এখন চালাও..”গাড়ি চলতে শুরু করেছে বেশ কিছুক্ষণ হোল..খোলা জানলা দিয়ে সাঁইসাঁই করে হাওয়া ঢুকছে..কাঁপা হাতে কাঁচ তুলে দিল সৌম্য..কে জানে..খোলা জানালা দিয়ে যদি বাকী স্মৃতিটুকুও হারিয়ে যায়??থাক..নাহয় স্মৃতিটুকুই থাক…