চৌধুরীহাট বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দির

আহ্সানুল করিম: অনেক দশক আগের কথা। তখন আমার বয়স সাড়ে নয় টয় হবে। তখন শৈশব কাটিয়ে বয়:সন্ধির দোর গোড়ায় এক রোগা ও ঢ্যাঙা সময়। বড় মাথা, চোঁয়াড়ে গাল, সাঙ্কেন আইজ আর সরু হাত পায়ের একটা হীনমন্য জ্যামিতির সময় ছিলো সেটা। তার আগে ফর্ম্যাল স্কুলিঙের অভিজ্ঞতা আমার নেই। কারণ প্রাথমিক শিক্ষাটা মূলত: আমাদের গৃহশিক্ষকের হাতেই ছিল। এতে করে ঐ বয়সের একটি শিশুর সামাজিক বিকাশের কী কী অন্তরায় হতে পারে, সেটা ভাববার সময় আমার পিতৃদেবের হাতে ছিল না। তখন আমরা অনেক ভাইবোন আর পিতৃদেবের লক্ষ্য ছিল সব ধরণের প্রতিকূলতা কাটিয়ে সব্বাইকে শিক্ষিত করে তোলা। কমপক্ষে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। তার একা মানুষের সংসারে আর কাজের চাপে আমার ক্লাস ফাইভে অ্যাডমিশানের সুযোগ চলে এলো অবশেষে “মিড-সেশনে”, ইংরেজী বছরের মাঝামাঝি। অ্যাডমিশনও তাই প্রথমে জুটল সি-সেকশানে। এ -সেকশানে ভালো ছেলেরা, বি-সেকশানে সব মেয়েরা আর সি-সেকশান অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী, অমনোযোগী আর অনিয়মিতরা পড়বে, এটাই ছিল দস্তুর।

এল প্যাটার্ণ স্কুল বাড়ি। শুরুতে হেডমাস্টারের রুম, কমন রুম, অফিস রুম, স্টাফ রুম তারপরে টানা মেয়েদের সেকশানসমূহ… তারপরে ছেলেদের নিচু ক্লাস, তারপরে এল জাংশান ঘুরে ক্লাস এইট, নাইন,টেন… তারপরে এক ধাপ নেমেই সেই ক্লাস ফাইভের সি-সেকশান। তারপরে আরেকটি ক্লাসের সি-সেকশান, ভাঙ্গা চেয়ার বেঞ্চিওলা একটি ফাঁকা ক্লাসরুম, একটি লাইব্রেরি। তারপরে বাথরুমসমূহ, কলতলা হয়ে একটু ফাঁকা। তারপরে কলেজ কলেজ দেখতে দালানবাড়ি। ওগুলো ইলেভেন টুয়েলভ্ এর ক্লাস। বাব্বা! সেখানে ছেলেমেয়েরা একসাথে ক্লাস করে। সেসব ভয়ে ভয়ে ছাড়িয়ে গেলে, কিছুটা জায়গা আন্ডার কন্সট্রাকশাান। তারপরে একটু তফাতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উঁচু ক্লাসসমূহের পাকাবাড়ি। তার চারদিকে পাকা বারান্দা, ওপরে টিনের চাল। তারপরেই বেশ নধর একটি পুকুর। পুকুরের পূব পাড়ে বিএসএফ ক্যাম্পের ঝাড়া লম্বা ওয়াচ টাওয়ার, মাটি উঁচু করা বাউন্ডারি, গার্ডেন আম্ব্রেলার মতো হাওয়াঘর যেমন আকর্ষণীয় ছিল, ঠিক তেমনি পুকুরের পূব-পাশের গাছগুলো ছিলো রোম্যান্টিক বাংলা কবিতার অলস দুপুরের মতো। মাঠের দুদিকে ফুটবলের গোল-পোস্টদুটো সারাদিন ঠায় দাঁড়িয়ে কত কী যে ভাবতো। যতক্ষণ বিকেল না হচ্ছে ততক্ষণ তাদের কোনও ব্যস্ততা ছিলো না, ভাবনাগুলো ছাড়া। তবে ঐ নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা গোলপোস্টদুটো নীরবে জীবনের অনেক শিক্ষা দিত আমাকে। একটা সীমারেখা, একটা সুস্থির প্রতীক্ষা, রোদ বৃষ্টিতে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকার দৃঢ়তা… এরকম কতো কিছু নীরবে শেখাতো তারা। আমাদের স্কুলের মাঠটি, আমাদের স্কুল বিল্ডিঙের বিশালতা, তার সজ্জা, আমাদের ঐ বড় স্কুলটার চারপাশের সৌন্দর্য, মোট শিক্ষকসংখ্যা… সেই জেলার অনেক গ্রামীণ স্কুলকেই টেক্কা দিতে পারত অনায়াসে। এত কিছু লেখার পরেও দেখছি তার ভূগোল বর্ণনার অনেক কিছুই বাকি।

অফিস চত্বরের সামনে বেদি। তাতে জাতীয়পতাকা তোলার পার্মানেন্ট ব্যবস্থা। ইট রঙা সেই বেদিতে লেখা ছিল NCC। সেইখানে হতো আমাদের মর্ণিং অ্যাসেম্বলি। জাতীয় সঙ্গীতের আগে পরে হেডমাস্টার মহাশয় নানারকম নোটিশ অ্যানাউন্স করতেন। আমরা শিক্ষার্থীরা উল্লম্ব কলামে দাঁড়াতাম আর একটু দূরে শিক্ষক মহাশয়রা পাশাপাশি লাইন করে দাঁড়াতেন আর আড় চোখে আমাদের দেখতেন। সাদা ধূতি পাঞ্জাবি, কালো ফ্রেমের চশমা, সাইড সিঁথিতে পেতে আঁচড়ানো কোকড়া কোকড়া চুল, হাফ হাতা ঘিয়ে কার্ডিগান পড়া হেডমাস্টার মশাই একাই চালাতেন অ্যাসেম্বলি। তার কমান্ডগুলো আজও কানে বাজে:
“শুরু ক’রো”
বা,
“আচ্ছা শুরু করো”
নোটিশ বলার আগে, “তোমরা শোন।” বা শুধুই “শোন”।
এই কথাগুলো বারে বারে শুনতে আমাদের কোনও ক্লান্তি ছিলো না। যেমন ক্লান্তি ছিলো না পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে সামনের সহপাঠীর মাথায় চুলে খোঁচা মেরে অন্যদিকে তাকাতে। এই ক্রিয়াপদটির খুব সুন্দর একটা চলতি কথা ছিলো: মাথায় “ট্যাবলানো”। সেই অ্যাসেম্বলি গ্রাউন্ড আর তার পাশে অানঅফিসিয়াল আর অফিসিয়াল সাইকেল স্ট্যান্ডের আসল গর্ব ছিলো দুটি হিউজ মাপের রেন-ট্রী। অবসরে হাত দিয়ে খুঁচিয়েই তাদের মোটা চামড়া তোলা যেত আঙ্গুলের ব্যায়াম করতে বা কাউকে “ট্যাবলাতে”। ক্লাস নাইন টেনের সামনেও বেশ ঝাঁকড়া মাথার একটা আম গাছ ছিলো, ঘন ছায়ার জন্য বিখ্যাত।

ছবি কৃতজ্ঞতা : সিভিভিএম অ্যালামনি গ্রুপ।

admin

Share
Published by
admin

Recent Posts

রবীন্দ্র সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা: শনিবার রাতে যান চলাচল বন্ধ থাকবে

কলকাতা, ১৬ নভেম্বর ২০২৪:শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্টের উদ্যোগে আগামী শনিবার রাত থেকে রবীন্দ্র সেতু…

2 days ago

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে ট্যাব বিতরণের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে, তদন্তে সিট গঠন করল কলকাতা পুলিশ

‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের ট্যাব বিতরণের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। বহু ছাত্রছাত্রীর ট্যাবের টাকা…

3 days ago

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল, বিজেপির বিক্ষোভে ধস্তাধস্তি

দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানা ব্লক আজ উত্তাল আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিজেপির ডাকে…

3 days ago

বিহারের জামুইতে ভগবান বীরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জনজাতীয় গৌরব দিবসে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

আগামীকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিহারের জামুই জেলায় জনজাতীয় গৌরব দিবস উদযাপন উপলক্ষে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে…

3 days ago

২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে

মহারাষ্ট্র বিধানসভায় আগামী ২০শে নভেম্বর একদফায় নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযান এখন তুঙ্গে। ঐ একই দিনে নান্দেথ…

5 days ago

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা

পাহাড়ে সফররত মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ দার্জিলিং-এর চৌরাস্তায় ‘সরস মেলা’র উদ্বোধন করবেন ।আগামীকাল তিনি যাবেন…

5 days ago