।। রাত্রির দিন ।।
( অনুগল্প )….
সবে ভোর হয়েছে….পূ’ব আকাশে জবাকুসুমের রঙ ছড়িয়ে সূর্য উঠেছে । গঙ্গার ধারে দু’একটা জেলে ডিঙি সওদা করছে, দু’একজন পুণ্যবান আধ কোমর জলে দাঁড়িয়ে সূর্য প্রণাম করছে । জলকাদা মাখা ঘাটের সিঁড়িতে রাত্রি বসে আছে দু’হাঁটুতে মুখ গুঁজে…তারও দু’চোখে লাল জবা, পরনে ওড়িশি নাচের আলুথালু বেশ, কাল রাতে গুরুজী তাকে ‘দেবদাসী’ বানিয়েছে !…
উত্তর কলকাতার স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে পড়ে থাকা মাছের আঁশ, স্যানিটারী ন্যাপকিন ডিঙিয়ে ( পরিবেশ সচেতনতার তোয়াক্কা করে না কেউ এখানে…) রাত্রিদের তিন পুরুষের পৈতৃক ভিটে । দোতলা বাড়ী, তিনতলায় ছাদ । সদর দরজা পেরিয়ে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে দু’খানা ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, এক ফালি বারান্দা…ওরা থাকে দোতলায়, নীচে এক ঘর ভাড়াটে রয়েছে সেই মান্ধাতার আমল থেকে । বাবা, মা আর ও…এই মিলে রাত্রিদের মধ্যবিত্ত সংসার । বাবা মাঝারি মাপের সরকারি চাকুরে, সাধ আর সাধ্যের মধ্যে ফারাক থাকলেও তা মেটানোর চেষ্টা রয়েছে; মা নিয়মমাফিক গৃহবধূ ।
দোতলার বারান্দার এক পাশে কয়েকটা টবে টগর, জবা, দুধেআলতা, তুলসী ।এবার গরমের গোড়ায়, রাত্রির বাবা হাট থেকে একটা মোতি বেলের চারা এনেছে…বর্ষার জল পেয়ে সে বেশ বেড়ে উঠেছে, ফুল ফুটছে তাতে । বেলা পড়লে রাত্রির মা যখন সন্ধ্যে দেয় ধূপ জ্বেলে, শাঁখ বাজিয়ে, বারান্দাটা ম ম করে মোতি বেলের শরীরী গন্ধে…রাত্রি বোল তোলে নাচের ছন্দে…কোনো কোনো দিন তার তাল কাটে একতলার ভাড়াটে বৌ এর অযথা হয়তো খানিকটা শ্লেষভরা চিৎকারে !
ছোটোবেলা থেকেই তার নাচে ভারী ঝোঁক…প্রথমে পাড়ার নাচের স্কুলে পাঁচমিশেলী নাচ শেখে । তারপর মহাপাত্র গুরুজীর কাছে ওড়িশি নাচের তালিম নিতে নাড়া বাঁধে, তাও সে ভারী জোর করে । মা বাঁধা হতে বলে…আমাদের মতো ঘরে তোর অমন নাচের পোশাক আশাক, সব মিলে অনেক খরচ, তাছাড়া কতো দিনই বা তুই পারবি নাচতে ? সেই তো খুন্তি নাড়তে হবে ! তার চেয়ে পড়াশোনাটা মন দিয়ে কর, বিয়ের বাজারে দর বাড়বে । তবুও বাবার গলা জড়িয়ে মেয়ের বায়না…আমি এক ঝলক আলো মেখে শরীরে, নাচতে চাই স্টেজ জুড়ে, আমাকে থামিও না বাবা ! অগত্যা মায়ের ওজর আপত্তিকে চাপা রাগে পরিণত করে চলতে থাকে রাত্রির শিল্পী হওয়ার সাধনা । পড়াশোনায় বেশ ব্যাঘাত ঘটে তাতে…মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে সাদামাটা রেজাল্ট করে, বি. এ জেনারেলে নামকাওয়াস্তে ভর্তি হয়েছে সে….কলেজে রেগুলার ক্লাস করতে পারে না, নাচের ট্রুপের সঙ্গে শো করতে প্রায়ই যেতে হয় তাকে কলকাতার বাইরে…
উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় বাংলা স্যারের কোচিং এ অয়নের সঙ্গে পরিচয় রাত্রির…আর্টস নিয়ে পড়লেও অয়ন মেধাবী ছাত্র । ইংলিশ অনার্স নিয়ে পড়ছে, পরে পশ্চাতে সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছে আছে । রাত্রির শরীর ভাঙা নাচ তাকে টানে…ওর প্রায় প্রতিটা শো তে হলে থাকে সে আর শো এর শেষে চেপে ধরে রাত্রির হাত দুটো…সে উষ্ণতায় ভারী ভরসা পায় রাত্রি । সেদিন উর্বশীর মতো নাচছিল রাত্রি…তারপর লোক চোখের আড়ালে অয়ন ঠোঁট রাখে তার ঠোঁটে…রাত্রি সম্মানিত হয় সে ভালোবাসায়আজকাল গুরুজী একটু বেশী নজর দিচ্ছে রাত্রির দিকে…নতুন মুদ্রা শেখানোর অছিলায়, দেখো বেটা বলে হাত দিচ্ছে কখনও তার বুকে, কখনও বা দেহের অন্য কোনো স্পর্শকাতর জায়গায় আর তাতে নাচকে অন্ধ ভালোবেসে সে মুখে কিছু না বললেও, সারাদিন একটা মন-খারাপ-করা ঘিরে থাকছে তাকে । ট্রুপের সিনিয়ার অদৃজা সেদিন বলে তাকে…কি হয়েছে তোর, এমন চুপ করে আছিস্ কেন ? প্রথমে সে বলে, শরীর ভালো নেই, গা জ্বরজ্বর করছে, তারপর জোরাজুরিতে সে বলে অদৃজাকে গুরুজীর কথা । তবে অদৃজা কোনো প্রতিবাদ করে না তাতে । রাত্রির মনে হয়, তার প্রচ্ছন্ন সায় আছে গুরুজীর এমন কাজে, না হলে ওপরে ওঠা যাবে না যে ! বাবা মাকে মুখ ফুটে বলতে পারে নি রাত্রি, গুরুজীর এ গুণপনার কথা পাছে তার নাচ থেমে যায় ! এমন কি অয়নকেও এ ব্যাপারে বলতে ওর মুখে বেধেছে ।
কাল সন্ধ্যেবেলা শো এর শেষে সবাই প্রায় চলে গেছে, গ্রীনরুমের এক পাশে রাত্রি গয়না খুলছে আপন মনে…গুরুজী মাতাল অবস্থায় জড়িয়ে ধরে ওকে পেছন থেকে, টেনে নিয়ে যায় পাশের এক ঘরে, তারপর, পশুর মতো ভোগ করে ওকে !…তবুও রাত্রি উঠে দাঁড়ায়…এসো গুরুজী আদর করি তোমায় বলে বিক্ষত শরীরের বাকী শক্তিটুকু এক করে সে দু’হাতে টিপে ধরে গুরুজীর গলা…প্রাণ হারিয়ে গুরুজী লুটিয়ে পড়ে তার পায়ে ! টলতে টলতে, রাত ভোর করে সে এসে পৌঁছয় জাহ্নবীর এ’ ঘাটে…কী করবে সে, তলিয়ে যাবে গঙ্গায় না ধরা দেবে চৈতন্যহীন সমাজের দো’রে…ভেবে কূল পায় না !…একটু পরেই পুলিশ, প্রশাসন, মিডিয়া জেগে উঠবে…সে ধরা পড়বে নামী দামী মানুষ খুনের দায়ে…তারপর, সময়ের পা ছুঁয়ে, মহামান্য আদালতে কিসের বিচার হবে…ধর্ষক শিল্পীর না শিল্পের ধর্ষণের না কি শুধুই খুনের ?!
……সুনন্দা হালদার ।।