বিকাশ সাহাঃ উত্তরবঙ্গে যে সমস্ত প্রাচীন কালি পূজো হয় তাদের মধ্যে অন্যতম উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ বন্দরের শ্রী শ্রী মা করুণাময়ী আদি কালিবাড়ির পূজো। ঐতিহ্য মেনে নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে রায়গঞ্জের বন্দরে ৫৩৯ বছর ধরে আদি কালী বাড়ির পূজো হচ্ছে। এই মন্দিরের পুজো যেমন অনেক পুরনো তেমনি এর ইতিহাসেও রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। এক পাঞ্জাবী সাধু সিদ্ধি লাভের আশায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাধনার জন্য বসলেও তিনি কোথাও সিদ্ধি লাভ করতে পারেননি । শেষে ৫৩৯ বছর আগে বন্দরের কুলিক নদীর ধারে এই ফাঁকা এলাকায় তিনি আসেন। এখানে এসে তিনি পঞ্চমুণ্ডির আসন তৈরি করেছিলেন। নিয়ম রীতি মেনে তিথি নক্ষত্র দেখে এই পঞ্চমুণ্ডির আসন তৈরি করেছিলেন ঐ পাঞ্জাবী সাধু। পঞ্চমুণ্ডির আসন তৈরি করার পাশাপাশি তন্ত্র সাধনা করে তিনি সারা জীবন এখানেই কাটিয়ে দিয়েছিল এবং সিদ্ধি লাভও করেছিলেন। সেই পাঞ্জাবী সাধুর নাম আজও অজানা সকলের কাছে। সেই সময় এখানে মায়ের কোন মূর্তি ছিলনা। পঞ্চমুণ্ডির আসনেই প্রতিমা বিহীন মায়ের পূজো করা হতো এখানে। সে সময় পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রতিমা না থাকলেও এখানে মায়ের নিত্য আবির্ভাব হত । মাঝে মধ্যেই মায়ের পায়ের নূপুরের আওয়াজ শুনেছেন অনেকে। ২০৬ বছর আগে এখানে কষ্টি পাথরের মা কালীর দেবী মূর্তি স্থাপিত হয়। রায়গঞ্জ এলাকায় মহারাজা দীননাথের বংশধরদের কাছারি বাড়ি ছিল। সাধক পাঞ্জাবী সাধুর পৃঠস্থানের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি কাছারি বাড়িতেও তা নিয়ে সোরগোল পরে যায়। ১৮০৯ সালে মহারাজা দীননাথের বংশধর শঙ্কর নাথ চৌধুরির উদ্যোগে পঞ্চমুণ্ডির বেদিকে ঘিরে গড়ে ওঠে মন্দির। যোগীবর যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বেনারসের মঠের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বেনারসের শঙ্করাচার্য মঠের সাধু সত্যানন্দতীর্থ দণ্ডস্বামী বেনারস থেকে এখানে মায়ের কষ্টি পাথরের মূর্তি আনেন। সেই সময় থেকে আজও নিষ্ঠা ভরে রায়গঞ্জের বন্দরে মা আদি কালী মাতার পূজো হয়ে আসছে। মূর্তি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বন্দরের আদি কালী মন্দিরের প্রথম পুরোহিত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন মদন মোহন। তিনি যোগীবর যোগেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠাকুরদা। সাধক গুরু ব্যামাক্ষ্যাপার আদেশে ও মায়ের দর্শন পাবার আশায় পুরোহিত মদন মোহন রায়গঞ্জের কুলিক নদীর ধারে মায়ের মন্দিরে আসেন । সে সময় তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন কালী পুজো দেখতে পশ্চিমবঙ্গ সহ বিহার ও দিল্লী থেকেও অনেক মানুষ এখানে আসেন। এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চলে চণ্ডীপাঠ, মঙ্গল আরতি সহ নিত্য পূজা। বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে রাত পৌনে এগারোটা থেকে মায়ের পুজো শুরু হয়। এখানে পাঁঠা বলির চল রয়েছে। বংশ পরম্পরায় পুজো করে আসা পুরোহিত পিন্টু চট্টোপাধ্যায় এখানে পঞ্চম পুরুষ হিসেবে পুজো করছেন।
পুরোহিত পিন্টু চট্টোপাধ্যায় বলেন, মায়ের এই আদি কালী পুজো নিয়ে নানা মহল থেকে নানা কথা শোনা যায়। এখানে জলদস্যুরা পূজো দিত এমন কোথাও লোক মুখে শোনা যায়। তার সত্যতা কতটা রয়েছে তা নিয়ে জনমানসে সংশয় রয়েছে। কিন্তু এটা ঠিক যে তদানীন্তন কালে জমিদার সহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা নৌকা নিয়ে ব্যবসা বানিজ্য করতে যাবার আগে ও ব্যবসা করে ফেরার পথে মায়ের পুজো দিতেন। ৫৩৯ বছর ধরে এখানে মা কালীর পূজো হয়ে আসলেও সে সময় মায়ের বেদিতে মূর্তিহীন মায়ের পূজো করা হত। ২০৬ বছর আগে এখানে কষ্টি পাথরের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময় থেকে আমরা বংশ পরম্পরায় মায়ের মন্দিরে পূজো করে আসছি। বর্তমানে এখানে পঞ্চম পুরুষ হিসেবে আমি পুজো করছি। লাইট ও প্যান্ডেলের আরারম্বর না থাকলেও এখানে নিষ্ঠা ভরে মায়ের পুজো করা হয়। রায়গঞ্জে আগে যারা থাকতেন বর্তমানে যারা রায়গঞ্জের বাইরে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তাঁরা পুজোর দিনে রায়গঞ্জের বন্দরের আদি কালী মন্দিরের এসে পুজো দিয়ে যান। মায়ের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে। সেদিনও ঘটা করে মায়ের পুজো করা হয়।
রায়গঞ্জের করুণাময়ী আদি কালিবাড়ির পূজো এবারে ৫৩৯ বছরে পা দিল
সোমবার,০২/১১/২০১৫
776