বিকাশ সাহাঃ উত্তরবঙ্গে নজরকারা পূজো হিসেবে পরিচিত ছিল উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনির পূজো। বৈদ্য সুস্থ্য থাকা কালীন সময়ে মৃন্ময়ী দেবীর আবির্ভাবে কোন রকম খামতি না থাকলেও তিনি অসুস্থ হওয়ার পর দেওর বৌদির রাজনৈতিক টানাপড়েনে গত বছর থেকে কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনির আভিজাত্য পূজোয় মৃন্ময়ী দেবীর আবির্ভাব না হয়ে হচ্ছে ঘট পূজো। ঘরের ছেলে বৈদ্য আর কেউ নয়, একদা রায়গঞ্জ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। ২০১৪ লোকসভা ভোটে ভাই পবিত্র রঞ্জন দাসমুন্সী তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে ও প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর স্ত্রী দীপা দাসমুন্সী কংগ্রেসের টিকিট নিয়ে রায়গঞ্জ লোকসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ফলে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হারতে হয় দীপা দাসমুন্সীকে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দাসমুন্সী পরিবারের হাত থেকে হাত ছাড়া হয় রায়গঞ্জ লোকসভা আসন। যদিয়ও লোকসভা ভোটে জয়লাভ করতে পারেন নি পবিত্র বাবুও। রাজনৈতিক কারণেই কি বাড়ির মূর্তি পূজো থেকে এবার একেবারে ঘট পূজোতে নেমে আসতে হল ? এমনই সব প্রশ্ন এক বছর ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক মহল থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
একটা সময় ছিল, যখন পূজোর চার দিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সাধারণ মানুষ থেকে হেভী ওয়েট রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের আনাগোনাতে মুখরিত হয়ে থাকত কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনির দাসমুন্সী পরিবারের এই বাড়ি। মন্ত্রী থাকা কালীন সময়েও চরম ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে পূজোর চার দিন কালিয়াগঞ্জে থাকতেন ঘরের ছেলে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। পূজোর খুঁটিনাটি আয়োজন থেকে শুরু করে সবাই খাচ্ছেন কি না তা নিজে দ্বারিয়ে থেকে তদারকি করতেন। সেই সঙ্গে তাঁর স্ত্রী দীপা ও ছেলে মিছিল দু জনেই ব্যস্ত হয়ে থাকতেন পূজোর কদিন। পূজোর দিন গুলিতে সময় করে কাছাকাছি গ্রাম গুলি ঘুরে আসতেন প্রিয় বাবু। কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনিতে অবস্থিত দাসমুন্সীর বাড়িতে ঢুকতেই বড়ো লোহার গেট। সেই গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে বাঁদিকে ছাদ পেটানো বড় দুর্গা মন্দির। সেই মন্দিরে ডাকের সাঁজে সজ্জিত এক চালার দুর্গা প্রতিমা নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে পূজো হতো। পূজোকে কেন্দ্র করে ভাইরা সবাই তাঁদের পরিবার সহ কালিয়াগঞ্জের বাড়িতে এসে উপস্থিত হতেন। প্রিয় বাবুর ভাইয়ের স্ত্রীরা পূজোর জোগাড়ে হাত লাগাতেন। পূজোর চার দিন ধূতি পাঞ্জাবী পড়ে মন্দিরের সামনে বসে সবার সঙ্গে সদা হাস্য মুখে কথোপকথনে ব্যস্ত থাকতেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। পূজোর চার দিন এই বাড়িতে রাজনৈতিক নেতা কর্মী থেকে শুরু করে কয়েক হাজার সাধারণ মানুষকে পাত পেরে খাওয়ানো হত । খাবারের মেনুতে কয়েক রকমের মাছ ছাড়াও থাকত খাশির মাংশ। প্রতি বছর প্রিয় বাবু নিজে গরীব মানুষদের হাতে বস্ত্র তুলে দিতেন। হাজার হাজার গরিব মানুষকে ধুতি, লুঙ্গি, শাড়ি দান করার ক্ষেত্রে দেখা হতনা ঐ ব্যক্তির রাজনৈতিক রঙ।
স্থানীয় বাসিন্দা তথা দাসমুন্সী বাড়ির মূর্তি পূজার মুল দায়িত্বে থাকা মিহির ভৌমিক (৮০) বলেন, জ্যোতিন্দ্র নাথ দাসমুন্সী ও রেণুকণা দাসমুন্সীর পুত্র প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। জ্যোতিন্দ্র নাথ দাসমুন্সীর বাড়ি ছিল বর্তমানে বাংলাদেশের বরিশালে। সেখানেই ঘটা করে দেবী দুর্গার পূজো করা হতো। বরিশালে জ্যোতিন্দ্র নাথ বাবুর জমি জায়গা ছিল, সেই সঙ্গে তিনি সেখানে ব্যবসা করতেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জ্যোতিন্দ্র নাথ বাবু পরিবার সহ চিরির বন্দরে চলে আসে। বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত চিরির বন্দর। সেখানে এসে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। আমরাও সেই সময় পাবনা থেকে চিরির বন্দরে সবে এসেছি। চিরির বন্দরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে জ্যোতিন্দ্র নাথ বাবু সহ তাঁর পরিবারের আলাপ ও পারিবারিক আত্মীয়তা গড়ে ওঠে। দেশ ভাগের পর দাসমুন্সী পরিবার ও আমাদের পরিবার এক সঙ্গে কালিয়াগঞ্জ চলে আসি। কালিয়াগঞ্জে জমি কিনে আমরা স্থায়ী ভাবে একাই পাড়ায় বসবাস শুরু করি। বরিশাল থেকে চলে আসার পর থেকে দাসমুন্সী পরিবারে না বরিশালে, না চিরির বন্দরে এমনকি কালিয়াগঞ্জে এসেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত দুর্গা পূজা শুরু হয়নি। জ্যোতিন্দ্র নাথ দাসমুন্সীর ও রেণুকণা দাসমুন্সীর ছয় পুত্র শিশির রঞ্জন দাসমুন্সী, নিখিল রঞ্জন দাসমুন্সী, ধ্রুব রঞ্জন দাসমুন্সী, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী, পবিত্র রঞ্জন দাসমুন্সী, অসীম রঞ্জন দাসমুন্সী ও এক কন্যা রেবা দাসমুন্সী। দাসমুন্সী পরিবারের ছয় ভাই পড়তেন কালিয়াগঞ্জ পার্বতী সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ে ও বোন পড়তেন কালিয়াগঞ্জ মিলনময়ী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। সেই সময় কালিয়াগঞ্জে জ্যোতিন্দ্র নাথ বাবুর সাবানের কারখানা ছিল, সেই সঙ্গে তিনি ঠিকাদারী ব্যবসাও করতেন। প্রিয় রঞ্জন দাসমুন্সী কালিয়াগঞ্জ পার্বতী সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেড়িয়ে রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকেই রাজনীতিতে তাঁর হাতে খড়ি। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে ছাত্র পরিষদ করত প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী। উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় গিয়ে সেখানে ছাত্র পরিষদ করার সুবাদে কংগ্রেসে যোগ দেন তিনি। এরপর কংগ্রেসের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে বিভিন্ন সময় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কালিয়াগঞ্জের বাড়িতে দেবী দুর্গার পূজো করার পেছনে একটি রহস্য রয়েছে। পবিত্র রঞ্জন দাসমুন্সী অল্প বয়সে এক সময় জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই সময় কলকাতার বড় বড় ডাক্তার তাঁর রোগ সারাতে পারেনি। এমনকি ডাক্তার বাবুরা জানিয়ে দিয়েছিল তাঁদের আর করার কিছু নেই। শেষে দাদা নিখিল রঞ্জন দাসমুন্সী মানত করে, ভাই সুস্থ্য হয়ে উঠলে বরিশালের দুর্গা পূজার মত করে কালিয়াগঞ্জের বাড়িতে দুর্গা পূজা করবো। দাদার মানত করার বেশ কিছুদিনের মধ্যে পুরোপরি সুস্থ্য হয়ে ওঠে পবিত্র রঞ্জন দাসমুন্সী। এরপর থেকে ধুমধাম করে চালু হয়েছিল কালিয়াগঞ্জের দাসমুন্সি বাড়ির পূজো। প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী সুস্থ্য থাকার সময় পুজোর কদিন ধরে তাঁর কালিয়াগঞ্জের বাড়িতে মানুষের মেলা বসে যেত। ষষ্ঠী, সপ্তমী ও অষ্ঠমীর দিন কয়েক রকমের মাছ সহ নবমীর দিন মাংশ ভাত পাত পুরে খেতেন কয়েক হাজার সাধারন মানুষ থেকে পার্টি কর্মী। সবাই খাচ্ছেন কি না তা নিজে দ্বারিয়ে থেকে তদারকি করার পাশাপাশি সবার হালহাকিকত জিজ্ঞেস করে নিতে তিনি ভুলতেন না। মহা অষ্ঠমী ও মহা নবমীর দিন দুর্গা মণ্ডপের সামনে জনসাধারনের জন্য আয়োজন করা হত আরতি প্রতিযোগিতা। ছোট থেকে শুরু করে বড়রাও আরতি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন । মহা অষ্ঠমী ও মহা নবমীর রাতে প্রতিযোগিতা শেষে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী সহ বাড়ির সবাই মিলে আরতি করতেন দেবী দুর্গাকে। ২০০৮ সালের পূজোয় শেষ বার প্রিয়রঞ্জন দামুসন্সী উপস্থিত ছিলেন কালিয়াগঞ্জের শ্রীকলোনির বাড়িতে। সেবার সে কি ধুনুচি নাচের ধুম। হেবী ওয়েট নেতারা প্রতিবারের মত সেবারের পূজোতেও এখানে এসেছিলেন। ২০০৮ সালের পূজোর কয়েক মাসের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পরে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী । প্রিয় বাবু অসুস্থ হবার পর ২০০৯ সালে ঘট পূজো করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের পর থেকে আবার মূর্তি তুলে পূজো চালু হয়। দেওর পবিত্র রঞ্জন দাসমুন্সী তৃণমূল কংগ্রেস থেকে ও বউদি দীপা দাসমুন্সী কংগ্রেস থেকে দ্বারানোয় তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক রেষারেষি শুরু হয়ে যায়। আর সেই রাজনৈতিক রেষারেষির ছাপ গিয়ে পড়েছিল বাড়ির অন্তরমহলে। যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দাসমুন্সী বাড়ির পূজোতে গত বছর থেকে আর দেখা যাচ্ছেনা দেবী মায়ের মৃন্ময়ী রুপ। ঐতিহ্যবাহী দাসমুন্সী বাড়ির মূর্তি পূজোর বদলে এবারও করা হবে ঘট পূজো।
ঐতিহ্যবাহী দাসমুন্সী বাড়ির মূর্তি পূজোর বদলে এবারও হবে ঘট পূজো
রবিবার,১১/১০/২০১৫
734