পূজোর আগে নতুন গানের তালে ঢাক বাজানোর মোহরায় ব্যাস্ত ঢাকি শিল্পীরা ঃ রায়গঞ্জ


বৃহস্পতিবার,২৪/০৯/২০১৫
699

বিকাশ সাহাঃ    বাঙ্গালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর এই তেরো পার্বণের শ্রেষ্ট উৎসব হল দুর্গা পূজা। পূজোর সময় আর পাঁচজন বাঙালী সারা বছর কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরে পরিবার পরিজনের সঙ্গে পূজোর চারটা দিন সময় কাটান, ঠিক তখন বৈশ্য পাড়ার ঢাকিরা পেটের তাগিদে পূজোর চারদিন পরিবার পরিজন ছেড়ে পূজা মণ্ডপেই কাটিয়ে দেন। এমনই হাজার বেদনা নিয়ে এবার পূজোর আগে নিজেদের গ্রামে বসেই ঢাকে নিত্য নতুন বোল তোলার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে ঝুনু বৈশ্য, হরেন্দ্র বৈশ্য, স্বাধীন বৈশ্য, ক্ষিতিশ বৈশ্য, বাপি বৈশ্য, বিশু বৈশ্যদের মত ঢাকি শিল্পীরা। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জের বৈশ্য পাড়ায় পূজোর মাস খানিক আগে থেকেই পেশাদার শিল্পীর মত ঢাকের বোল তোলার মোহরা সেরে নিচ্ছেন ঢাকি শিল্পীরা। সারাদিন কেউ লেবারের কাজ করে, কেউবা আবার মাঠে অন্যের জমিতে কায়িক পরিশ্রম সেরে বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাঁদের শিল্পচর্চা করেন পূজোর দিন কয়েক আগে। আর তাই গোটা বছর তাকের উপর ওঠানো, কাপড় মুরি দেওয়া ঢাকগুলিকে ঝেড়ে মুছে পরিস্কার করে, রশিতে টান দিয়ে বাজানোর উপযোগী করে তোলেন তাঁরা। রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জের বৈশ্য পাড়ায় প্রায় প্রতিটি পড়িবারই ঢাক বাজানোর সঙ্গে যুক্ত। আর পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে এই গ্রামগুলির চিত্রটা একটু ভিন্ন ধরণের। কারণ এখানকার ঢাকিরা বাপ ঠাকুরদার জাত ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখতে বধ্য পরিকর। তাঁরা দারিদ্র্যতার কারণে পূজোর চারদিন সঙ্গ দিতে পারেন না নিজের সন্তান ও স্ত্রীকে। তাই পূজোর চারদিন রায়গঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জের বৈশ্য পাড়ায় দেখা যায় বেদনার সুর।
ঢাকি শিল্পীদের স্ত্রীরা জানান, আর পাঁচ জন যখন পূজোর চার দিন নিজের পরিবারের কর্তার সঙ্গে পূজো দেখতে বেরোয় তখন তাঁদের খুব খারাপ লাগে। পূজোর চারদিন প্যান্ডেল ও আলোক রোশনাই দেখতে রাতেই বেশী ভালো লাগে। কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে রাতে একা একা পূজো দেখতে যেতে পারেন না তাঁরা। ছেলে মেয়েরা পূজো দেখার বাইনা করে কান্নাকাটি করে। পূজোর দিনে বাচ্চাদের কান্নাকাটি দেখতে আর ভালো লাগেনা। কিন্তু বাড়ির কর্তাকে মানাও করতে পারেন না পড়িবারের গিন্নীরা। কারণ সেই সময় ঢাক বাজিয়ে কিছুটা হলেও বাড়তি টাকা ঘরে ঢোকে।
ঢাকি শিল্পীদের সন্তানরা জানান, সবাই পূজোতে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ায়, আমাদের বাবা পূজোর দিন গুলোতে বাড়িতে না থাকায় আমরা পূজা দেখতে যেতে পারিনা। প্রতিবার বন্ধুদের মুখে শুনতে হয় এই ক্লাবের প্যান্ডেল খুব সুন্দর ঐ ক্লাবের লাইটিং দারুণ। পূজোর চারদিন বাড়িতে বসে থাকতে আমাদের আর ভালো লাগেনা।
ঢাকি শিল্পী বিশু বৈশ্য বলেন, আগে যে তালে ঢাক বাজানো হতো এখন তা অচল হয়ে গিয়েছে। আধুনিক যুগে ক্লাব কর্তারা চান আধুনিক বাংলা ও হিন্দি গানের তালে ঢাক বাজাতে হবে। পূজো কমিটির অণুরোধে আমরা নাচের উপযোগী তালে ঢাক বাজাই। ক্লাব কর্তাদের কথামতো ঢাক বাজালে তাঁরা খুশি হয়ে বকশিস দেন আমাদের। যা দিয়ে আমরা ঐ কদিনের পকেট খরচা করতে পারি। আমরা অনেকেই পূজোতে জেলায় না থেকে ঢাক বাজানোর জন্য শিলিগুড়ির পূজো কমিটির ডাকে আমরা সেখানে গিয়ে ঢাক বাজাই। এখানকার পূজো কমিটির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ টাকা পাই শিলিগুড়িতে গিয়ে।
ঢাকি শিল্পী হরেন্দ্র বৈশ্য বলেন, আগের তুলনায় বর্তমানে ঢাক তৈরি করতে ও ঢাক সাজাতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বর্তমানে একটি ঢাক তৈরি করতে খরচ হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। প্রথমে ঢাকের সমান মাপের কাঠের গোলাই কিনতে হয়। তাঁর দাম পরে ২৫০০ টাকা। ঐ কাঠের গোলাই দিয়ে ঢাকের খোলস বানাতে মিস্ত্রি নেয় ১৫০০ টাকা। কামারের কাছ থেকে একটি ঢাকের জন্য ২৫০ টাকা দিয়ে একটি লোহার চাক বানিয়ে আনতে হয় । ঢাকের দু ধারের জন্য কসাইয়ের কাছ থেকে একটি খাশির কাঁচা চামরা কিনে আনি। সেই চামরার পিচ্ছিল দিকে চুন লাগিয়ে তা ভাঁজ করে জলে ডুবিয়ে রাখতে হয়। পরদিন সকালে জল থেকে চামরাটি তুলে কিছুক্ষণ হাত দিয়ে ঘষলে লোম সহ চামরার সাথে লেগে থাকা তৈলাক্ত ভাব আর থাকেনা। তখন সেটিকে ভালোভাবে ধুয়ে টানটান করে রোদ্রে শুকোনোর পর তা ঢাকে লাগাই। এরপর লাইলনের দরি দিয়ে টানটান করে বাঁধলে ঢাকটি ব্যবহার করার উপযোগী হয়। ঢাকের সৌন্দর্য আনতে রংচঙ্গে কাপড় লাগানো হয়। কাঠের ঢাক অনেক বছর চললেও প্রতি বছর পূজার আগে নতুন চামরা, নতুন রশি ও নতুন কাপড় ঢাকে লাগাতে হয়। তার জন্য বছরে একটা আলাদা খরচা হয়। দিনদিন খরচার পরিমাণ বাড়লেও পূজো উদ্যোক্তারা ঠিকমত পারিশ্রমিক দিতে চান না। পূজোর বেশ কিছুদিন আগেই ক্লাব কর্তারা তাঁদের ক্লাবে বাজানোর জন্য বাড়ি বয়ে এসে ঢাকের অর্ডার দিয়ে যান। দুটি ঢাক ও একটি কাঁসির জন্য এবার আমাদের ৮০০০ টাকা নিচ্ছি। যা পারিশ্রমিক হিসেবে খুবই কম।
ঢাকি শিল্পী বাপী বৈশ্য বলেন, আমি প্রথমে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইনি। কিন্তু বাবা আমার হাতে তাঁর ঢাক দিয়ে বলেছিলেন এই ঢাকটা তোর কাছে রাখিস। বাবার কথা রাখতেই আমি আজ বাপ ঠাকুরদার ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। সারা বছর বিভিন্ন কাজ করি। যখন যে কাজ পাই সে কাজই করি। কখনও রাজমিস্ত্রির লেবার, তো কখনও মাঠে দিন মজুরের কাজ করে সংসার চালাতে হয়। ঢাক তো আর সব সময় বাজানো হয়না, বিভিন্ন পূজা পার্বণে বিশেষ করে দুর্গা পূজা ও কালী পূজাতে ঢাক বাজানোর জন্য আমাদের ডাক পড়ে। পূজোর দিন গুলিতে বাড়িতে থেকে সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেবার ইচ্ছা আমাদেরও করে। কিন্তু পারিবারিক আর্থিক অনটনের জন্য পূজার দিনগুলোতে আমাদের বাড়তি উপার্জনের আশায় পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকতে হয়।
অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র জীবন বৈশ্য বাবার সঙ্গে কাঁসি বাজায়। সেও পূজার চারদিন বাবার সঙ্গে পূজা মণ্ডপেই কাটিয়ে দেয়। জীবন জানায়, পূজোর সময় বাড়ি ছেড়ে, বন্ধু ছেড়ে পূজো প্যান্ডেলে থাকতে ভালো লাগেনা। কিন্তু আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। তাই আমি বাবাকে সাহায্য করতেই বাবার সঙ্গে পূজো মণ্ডপে গিয়ে কাঁসি বাজাই।
ঢাকিদের পরিবার পরিজনদের আক্ষেপ ছোট থেকে জীবনের অনেকটা সময় যারা ঢাক বাজিয়ে অতিবাহিত করেছেন, তাঁদের জীবনের পরম মুহূর্তে সরকার তাঁদের আর দেখেন না। তাই ঢাকিদের অবস্থা খুবই খারাপ।
যারা নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে অপরকে আনন্দ দেবার জন্য পূজোর দিন গুলিতে বাইরে কাটাচ্ছেন তাঁদের চোখের আড়ালে থাকা অদৃশ্য অশ্রু বিন্দু আমাদের দৃষ্টি গোচরের বাইরেই থেকে যায়।

চাক‌রির খবর

ভ্রমণ

হেঁসেল

    জানা অজানা

    সাহিত্য / কবিতা

    সম্পাদকীয়


    ফেসবুক আপডেট