খবরইন্ডিয়াঅনলাইনঃ অদ্ভুত লাগলেও কথাটা সত্য। এমনটা অহরহ ঘটছে। অথচ শোবার ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই সেই সব নির্মম ধর্ষণকাণ্ড রয়েছে বন্দি। আর নারীকে লোকলজ্জার ভয়ে নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে ‘পতিদেবতার’ দানবীয় অত্যাচার, আজীবন। খবর ডয়েচ ভেল
জাতীয় অপরাধ গবেষণা ব্যুরোর মতে, পারিবারিক হিংসার মধ্যে স্ত্রীর ওপর স্বামীর যৌন অত্যাচারের ঘটনা সবথেকে বেশি। ভারতের প্রায় ৬০ শতাংশ পুরুষ স্বীকার করেছেন, নিজেদের যৌনসুখ উপভোগ করতে তাঁরা ইচ্ছামত স্ত্রীর ওপর শক্তি প্রয়োগ করেন।
২০১৪ সালের আন্তর্জাতিক নারী গবেষণা কেন্দ্রের সমীক্ষা বলছে, গড়পড়তা ভারতীয় পুরুষ বউয়ের ওপর পৌরুষত্ব ফলাতে যখন খুশি, যেমন খুশি তাদের কাম চরিতার্থ করে থাকেন, স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোবাসা বা শারীরিক অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, গর্ভবতী স্ত্রীকে দেহমিলনে বাধ্য করায় গর্ভপাত পর্যন্ত হয়েছে। অভিযোগ? কার কাছে? বাড়িতে করলে উল্টে টিটকিরি শুনতে হয়, খেতে হয় গালাগাল। আর পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে, তা ধোপে টেকে না। স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ? এ আবার কী? ভাবটা এমন, যেন এটা স্বামীর জন্মগত অধিকার। তাই মুচকি হেসে পুলিশ ধর্ষিতা নারীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
২০১৪ সালের ওই সমীক্ষাটিতে বলা হয়, প্রায় ৬০ শতাংশ ভারতীয় পুরুষ স্বীকার করেছেন যে, তারা যৌন সম্ভোগের জন্য মদ্যপ অবস্থায় নিজের বৌ-এর ওপর জোর জবরদস্তি করেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই মারধর পর্যন্ত গড়ায়। এতে নাকি তাঁদের যৌনসুখ বেশি হয়, যা কিনা ‘স্যাডিজম’ বা মর্ষকামের নামান্তর। আদতে এই পাশবিকতা নীরবে মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই, কারণ ব্যক্তিটি স্বামী নামের পুরুষ!
গতি নেই, কারণ ভারতীয় সমাজে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের ধ্যান-ধারণার গোড়ায় গলদ। সংসদে খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দোহাই দিয়েছেন যে, ভারতে বিয়ের সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কার আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। স্বামী যদি তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন, তাহলেও ভারতীয় সংস্কৃতি ও রীতিনীতির প্রেক্ষিতে তা অবৈধ নয়।
মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’-এর দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান মীনাক্ষী গাঙ্গুলি মনে করেন, খোদ সরকার যদি ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক কারণে এটাকে অবৈধ বলে মেনে না নেয়, তাহলে সেটা স্পষ্টত একটা অপরাধ। সরকার যে বার্তা দিতে চাইছে, তার অভিঘাত সমাজের ‘লিগ্যাল জাস্টিস সিস্টেম’-এর গভীর পর্যন্ত গেছে। এই বার্তার নিহিত অর্থ সহজবোধ্য। তাঁর তির্যক বক্তব্য : ”স্ত্রীকে ইচ্ছামতো ভোগ করার জন্য তাঁর অনুমতির দরকার কি? স্ত্রী যে স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তাই স্ত্রীকে যৌন খেলনা হিসেবে ব্যবহার করার একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে ‘পতিদেবতার’।” বলা বাহুল্য, এভাবেই ভেসে যায় নারীর সব শিক্ষাদীক্ষা, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা ও মর্যাদাবোধ।
পাশাপাশি সমাজের একাংশ মনে করেন, স্বামী যে ধর্ষণ করেছে তা প্রমাণ করা মুশকিল। এ জন্য নারীকে ধর্ষণের পর পরই যেতে হবে হাসপাতালে। প্রমাণ করতে হবে দেহের বা যৌনাঙ্গের কতটা ক্ষতি হয়েছে। এটা প্রমাণ করতে না পারলে কোনো অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে লাভের থেকে লোকসান হবে বেশি। ভেঙে যাবে বিবাহিত জীবন, ভেঙে যাবে সংসার, ভেসে যেতে পারে সন্তানের ভবিষ্যতও। সাধারণ ভারতীয় সমাজে ‘সিঙ্গল উইম্যান’ বা একক নারীদের অনেকেই ভালো চোখে দেখেন না। দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ ভারতীয় মহিলাদের আর্থিক আত্মনির্ভরতা নেই। অন্যদিকে পুরুষ নামক পতিদেবতার এতে কিছু এসে যায় না। তিনি কিন্তু ইচ্ছামত চলে যেতে পারেন গণিকাদের কাছে, কামসুখের চাহিদা মেটাতে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলির কথায়, ‘আসল সমস্যাটা হয়ত পুরুষের নয়, স্ত্রীর নয়, বিয়ে নামক বন্ধনেরও নয়। সমস্যাটা হয়ত পুরুষতান্ত্রিকতার। সেটাকে উপড়ে ফেলা কি সম্ভব? সমাজের বিবেক কি বুঝবে না, বিয়ে মানে স্রেফ দেহমিলন নয়, মনেরও মিলন, যার মন্ত্র ভালোবাসা? ধর্মীয় সংস্কারের দোহাই দিয়ে এই ধরনের পাশবিকতাকে নারী সমাজ আর কতদিন মেনে নেবে?” শুধু তাঁর নয়, এ প্রশ্ন কিন্তু অনেকেরই।’