সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়, পুরুলিয়াঃ এসেছে একটার পর একটা বিশ্ব নারী দিবস। প্রতিবারই আশায় বুক বেঁধে পুরুলিয়ার নাচনীরা। তবু শেষ পর্যন্ত কোনও ব্যাতিক্রম ঘটেনি পোস্তবালা, কল্লাদেবী, যশোদা বা বিমলাদেবীর মতো বিগত যৌবনা নাচনীর জীবনে। যে অন্ধকারে তারা ছিলেন আজও রয়ে গেছেন সেই অন্ধকারেই। অসহনীয় দারিদ্র সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এই দুইয়ের মাঝে পড়ে থাকা এই বৃদ্ধা শিল্পীরা এখন শুধু অপেক্ষা করছেন জীবনের অন্তিম ক্ষণের। নাচনী নাচ পুরুলিয়ার এক জনপ্রিয় লোকশিল্প। নাচনীরা পুরুলিয়ার এক অনন্য সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। ২০০৭ সালে এই পেশায় যুক্ত শিল্পীদের স্বীকৃতি সম্মান দেয় রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার। ২০১১’র মাঝামাঝি সময়ে লুপ্তপ্রায় এই সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্যে পুরুলিয়ার শহরের উপকণ্ঠে পুরুলিয়াতে মানভূম লোকসংস্কৃতি ও নাচনী উননয়ন এবং গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তারপরও এই শিল্পীদের অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং বৃদ্ধা নাচনীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অভাব-অনটনে এমনকি অনাহারেও মারা গেছেন। যারা জীবিত রয়েছেন তারা লড়াই করে যাচ্ছেন সীমাহীন দারিদ্রের সঙ্গে। সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়ে একটি নাচনী গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করলেও নাচনীদের সার্বিক সুরক্ষার জন্য তেমন কোনও পদক্ষেপ আজও গ্রহণ করেনি। যন্তনা আর ক্ষোভ নিয়ে পুরুলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে কোনমতে জীবন কাটাচ্ছেন এই মহিলারা। নির্বান্ধব জীবনে তাদের কয়েকজনার সঙ্গী তাদের রসিকরা। নাচনীদের বিচিত্র জীবনে রসিকরাই সব। নিজের যৌবনে রসিকদের অধীনে থেকেই তারা আনন্দ দেন সাধারণ মানুষজনকে। নাচনীরা নাচ করেন রসিকদের গাওয়া গানের তালে তালে। রসিকদের রক্ষিতা হয়ে থাকতে হয় নাচনীদের। ফাঁকা সময়ে ঝিয়ের মতো কাজ করতে হয় তাদের পরিবারের জন্য। মানব অধিকার যেন তাদের জন্য নয়।
বছর খানেক হল মারা গেছেন এককালের প্রখ্যাত নাচনী হাজারীদেবী। শেষ জীবনে মানবাজারের হাটে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনধারণ করেছিলেন তিনি। আড়শার সটরা গ্রামে প্রচণ্ড অভাবে রয়েছেন বিমা দেবী। শিরকাবাদে থাকা বৃদ্ধা শুকুরমনিদেবী ও সেনাবনার বাসিন্দা চারুবালাদেবীও কোনমতে আত্নীয়দের দয়ায় দিন পাত করছেন। এখন পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে পুরুলিয়ার দুর্বার মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত আবাসে রয়েছেন নাচনী শিল্পী পস্তবালা দেবী এবং রসিক বিজয় কর্মকার। দিন চলছেনা তাদেরও। এলাকার একটি চাল মিল থেকে চালের কণা সংগ্রহ করে তাই রান্না করে খান তারা। কোনও মতে বেঁচে আছেন এটুকুই। পুরুলিয়ার প্রচণ্ড শীতে সীমাহীন কষ্টই তাদের সঙ্গী। যৌবনে সবটুকু উজাড় করে দেওয়া এই নাচনীরা পাননি কোনও সরকারি ভাতা, নৃত্য প্রদর্শনেও ডাকও আসেনা আর আজকাল। জীবন থেকে যে যৌবন চলে গেছে তাদের। তারা যেন সমাজের কেও নন। নাচনীদের এই অবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির গবেষক, সমাজকর্মী প্রশান্ত রক্ষিত বলেন সরকারি স্বীকৃতি পাওয়ার পর শুরুলিয়াতে নাচনী একাডেমি গড়ার কথা ছিল, বৃদ্ধাশ্রম, সংগ্রশালা, অতিথিশালাও হওয়ার কথা ছিল। কোনও কিছুই হয়নি। আগে নাচনীদের মৃত্যুর পর তাদের পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হতো। সভ্যতার সাথে সাথে এমন জঘন্য কাজ আর করা হয়না এটা সত্যি। তবু সমাজ বা সরকার আজও আপন করে নেয়নি তাঁদের। নাচনীরা আজও সমানভাবে অবহেলিত ও নিপীড়িত। সমাজ ভীষণভাবে উদাসীন তাদের নিয়ে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কথা শোনেননি এই মহিলা শিল্পীরা। তেমন একটা দিনের কথা শুনে একটাই কথা বললেন পস্তুবালা, ‘ আমরাও তো নারী এদিনের পর থেকে আমাদের জন্য যদি সরকার একটুও ভাবেন তবেই সার্থক হবে এই দিন।’
পুরুলিয়ার নাচনীরা কেমন আছেন বিশ্ব নারী দিবসে
রবিবার,০৮/০৩/২০১৫
2932