সাধন মন্ডল, রাইপুর, বাঁকুড়াঃ রাজা নেই, নেই রাজত্বও। তবু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে সমান ভাবেই প্রাসঙ্গিক দুই শতাব্দী প্রাচীন মটগোদার শনিমেলা। প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো এই মেলাতে এখন লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রতি বছরই মাঘ মাসের শেষ শনিবার রাইপুরের মটগোদাতে এই মেলা বসে। আগে মেলাটি সাত দিন ধরে চললেও বর্তমানে তা প্রায় ১৫ দিন ধরেই চলে বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছেন। কীংবদন্তী অনুযায়ী, শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের ভগবানবাঁধের পাড়ে ধর্মরাজ ঠাকুরের অবস্থান ছিল। একদিন তিনি এখানকার রাজা ছত্রনারায়ন তুঙ্গদেওকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে ঠাকুর রাজবাড়িতে আনার নির্দেশ দেন। পরবর্তীকালে মেদিনীপুরের নেতাই গ্রামের বৈকুণ্ঠ ধীবর এই দেবতার পূজো করার দায়িত্ব পান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১২৪৭ সালে শ্যামসুন্দরপুরের রাজা ছত্রনারায়ন তুঙ্গদেও -এর পুত্র সুন্দরনারায়ন তুঙ্গদেও মটগোদার ক্ষেত্রমোহন পন্ডিতকে ঠাকুরের পূজো করার জন্য জমি দান করেন। এছাড়া ঠাকুরের পূজো করার দায়িত্বও দেওয়া হয়। সেই থেকেই এই পরিবারের সদস্যরাই ধর্মরাজ দেবতার পূজো করে আসছেন। বর্তমান পুরোহিত পরিবারের সদস্য রবীন্দ্রনাথ পন্ডিত বলেন, ‘ রাজাদের কাজ থেকে লিখিত ভাবে এই পূজো করার দায়িত্ব এবং পূজোর জন্য আমাদের পরিবারকে রাজা জায়গা দান করেন। তখন থেকেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই পূজো করে আসছেন।’ পুরোহিত পরিবার সূত্রের খবর, বছরের প্রতিটি দিনই সকালে একবার ভোগ দিয়ে এই দেবতার পূজো করা হয়। এছাড়া সন্ধ্যের সময় আরতি করা হয়। তবে ধর্মঠাকুরের পূজোকে কেন্দ্র করে এই মেলা কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে এলাকাবাসীর। কিন্তু প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ শনিবারে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয় বলে এটি শনি মেলা নামে পরিচিতি লাভ করেছে বলে পুরোহিত পরিবার সূত্রের খবর। স্থানীয় সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, আগে এখানকার জঙ্গলমহলের মানুষ আধুনিকতার কোনো মুখই দেখতে পায়নি। তাই উন্নত কোনো বাজারের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করার জন্য এই ধরণের মেলাগুলিকেই বেছে নিত এখানকার মানুষজন। এক সময় রানিবাঁধ, ঝিলিমিলি, সারেঙ্গা, সিমলাপালের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকেও অনেক লোক এই মেলায় আসতো। সারা বছরের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতো। তবে বর্তমানে ঐতিহাসিক এই মেলাটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। আগে মেলায় শুধুমাত্র নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসই বিক্রি হতো। জামাকাপড়, শিলনোড়া সহ বিভিন্ন সামগ্রী কেনার জন্য এই মেলায় ভীড় জমাতো জঙ্গলমহলের মানুষজন। বর্তমানে বিভিন্ন আলোর কারসাজি, বৈদুতিন নাগরদোলা প্রভৃতির কারণে মেলাটি সময় উপযোগী বলে মনে করছেন এলাকার সাধারণ মানুষজন। এছাড়া কয়েকবছর আগেও এই মেলাতে আসত মিনি চিড়িয়াখানা, ফটো তোলার জন্য বসতো অন্তত কুড়িটি স্টুডিও। কিন্তু বর্তমানে আইনের জটিলতায় সে সব চিড়িয়াখানা বন্ধ হয়ে গেলেও মেলার রেশ এখনো সমান ভাবেই রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। মটগোদার বাসিন্দা অশোক পাল, গৌতম গোস্বামী এঁরা বলেন, ‘ এখন মেলার জমক আরো বেশী। আধুনিকতার সাথে সাথে মেলাটিও সেজে উঠেছে। বিভিন্ন নাগরদোলা, প্রচুর দোকানপাট মেলাটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।’ তবে এখন মেলাটি আর রাজাদের মেলা হিসেবে পরিচিত নয়। একসময়ের রাজাদের মেলা বর্তমানে পরিনত হয়েছে সর্বজনীন শনি মেলায়। মেলা কমিটির সদস্য শান্তিনাথ মন্ডল বলেন, ‘ আগে শ্যামসুন্দরপুর গ্রামের রাজারা এই মেলা চালু করলেও বর্তমানে আমরা অনেকেই মিলে এই মেলাটি পরিচালনা করি। এছাড়া মেলাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য পুলিশের সাহায্যও নেওয়া হয়।’
শতাব্দী প্রাচীন মটগোদার শনিমেলা
বুধবার,১৮/০২/২০১৫
1155